আমি গ্রামীন জনগোষ্ঠীর সাথে বসবাসকারী একজন মানুষ, যে জীবনে সবসময়ই লেগে আছে কাদামাটি আর সোঁদা গন্ধ। গ্রামে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী সকলেই যে কাদামাটির কাজে নিয়োজিত তা কিন্তু নয়, তবে বেশিরভাগ মানুষ কৃষি পেশায় জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন যাঁদের ভিতরে আমিও একজন। ছোটো খাটো একটু লেখালেখির পাশাপাশি পারিবারিক জীবিকা নির্বাহে কৃষি হলো আমর মূল কাজ। বেশিরভাগ সময়ই কৃষি কাজে সম্পৃক্ত তাই আমারও সারা শরীর জুড়ে থাকে নানান জমির ধুলো কাঁদা আর সোঁদা সোঁদা গন্ধ। গ্রাম থেকে শহরের দুরত্ব প্রায় ৫ কিলোমিটার, সহসাই জামাটা ইস্তিরি করানো যায়না বা শহরে গেলেও সাধ্যের বাইরে ইচ্ছে পূরন করতে পারছিনা। স্বল্প জমিতে একমাত্র উৎপাদিত ফসলের ওপর নির্ভর করে একটি পরিবার, যা দ্বারা এতটুকু বাড়তি চাওয়া পাওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। এসব নানান ঘর্মাক্ত পরিশ্রমের পরেও রাত জাগার বড় একটি নেশায় আমাকে আসক্ত করেছে নিদারুন ভাবে। শারিরীক ভাবে অনেক সময় অসুস্থ হলেও রাতজাগা আমাকে কখনোই ছাড়ছে না। বই, পত্রিকার পাতা, কাগজ কলমই হলো আমার রাত জাগার রসদ। যা-ই হোক নিজের কথা আর নাই-বা লিখলাম তবে বাড়ির পাশের পড়সিদের নিয়ে একটু বলতেই হয়। গ্রামীন জনজীবনে আর যা-ই হোক সকলের সাথে সকলে বৈষম্যহীন ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও সৌহার্দপূর্ণতায় ভরপুর থাকে যা শহরে বারো বাড়ির ১২ জনের হৃদয়ে খুব একটা পাওয়া যায়না। তারপরেও গ্রামের একশো শতাংশই পরমতসহিষ্ণুতা যে প্রয়োগ করে তা কিন্তু নয়। বাড়ির পাশের কিছু কিছু পড়সি আছে যাদের জমিজমা ও টাকা পয়সা একটু বেশি হলে ভেতরে ভেতরে একটু আধটু দাম্ভিকতা, হিংসে, নিন্দের রুপ প্রকাশ পায়। ৪৩ টাকা বেশি দামের একটি নতুন লুঙ্গি পরে গ্রামের চায়ের দোকানে সন্ধ্যা বেলা পায়ের ওপর পা তুলে থর থর করে ঊরু কাপানো বেঞ্চের দিকে আর সকলের দৃষ্টি ফেরাতে চাওয়া মানুষটি ১০ মন ধান এবারে বেশি পেয়েছে। কেউ কেউ বলেছ, ভাইরে একদম (নসার) নতুন জামাইয়ের মত লাগছে মনে হয় (বেমালা) বেশী দামের লুঙ্গি? লুঙ্গি ওয়ালা: হয় (আডে) হাটে সবসময় (ওডেনা) ওঠেনা। পিছন ফিরে তাকাতেই লুঙ্গি ওয়ালার চোখে চোখ পড়তেই তার চোখে যে এক প্রকার উচ্চাভিলাষী, দেমাগ,অহংকারে জড়ানো ছিলো তা এক পলকেই অনুমান করতে পেরেছি। ঠিক তার ৩ মাস বাদে যখন তার চাইতে ৬২ টাকা বেশি দামে আমি লুঙ্গি কিনেছি তখন সেই দোকানের উপস্থিত সকলে (দুলা মিয় দুলা মিয়া) নতুন জামাই নতুন জামাই বলে সাদরে গ্রহণ গ্রহন করলো তখন ঐ লুঙ্গি ওয়ালা পাশের লোকটাকে বলেছিল, আমার লুঙ্গি না-কি ১২৪ টাকা কমে বাজারে বিকায়। পাশের লোকটি তখন তার কথায় সায় দিয়ে বলেছিল (আমনের চাইয়া) আপনার চাইতে বেশি দামের লুঙ্গি এই গ্রামে (কেডা হেন্দে) কে পরে? পাশের লোকটির সায় দেওয়ার কারন হলো তখন তার জমির পরিমান কিছু বেশি এবং ধানও তেমনি বেশি পায়। এরকম হাজারো পড়সি নিতী প্রয়োগ হয় গ্রামের জনগোষ্ঠীর মাঝে তবে তা মাঝে মাঝে অন্তর্দন্দ এবং বাহ্যিক কোন্দলে রুপ নেয়। ঠিক শহরের বেলায় এসব আরশি পড়সিদের এটা ওটা কেনা, চাকরি, পদ পদবী বড় ছোট নিয়ে অনেক দেমাগি নিতী নৈতিকতা প্রয়োগ হয়ে থাকে যা মাঝে মধ্যে প্রকট বৈষম্যের আকার ধারন করে। এবার মূল প্রসঙ্গে আসতে চাই। আমাদের দেশের সাংবাদিকতায় একধরনের নতজানু, হিংসা, বিদ্বেষ, পরমতঅসহিষ্ণুতা, দলদাস ও অনৈতিকতা বিরাজ করছে, যার সাথে সাথে সাংবাদিকতায় বেড়েছে অস্থিরতা, অপ-সাংবাদিকতা ও কথিত সংগঠনের দৌরাত্ম। দেশের বিভাগ, জেলা,উপজেলায় প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে বিভিন্ন নামের সাংবাদিক সংগঠন যার বেশিরভাগ সংগঠনের বৈধতা নেই, নেই কোন সাংগঠনিক নিতীমালা। একেকটি উপজেলায় প্রায় তিন থেকে সাত আটটি সংগঠন তৈরী হয়েছে, নিত্য নৈমিত্তিক চলছে প্রতিযোগিতা, অফিস পাড়া মহল্লায় কার্ড ঝুলিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এখানে-সেখানে।
বস্তুনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়নতা, নির্ভুলতা, সত্যবাদিতা ও সহমর্মিতা চলমান পেশাটি থেকে বেমালুম বিলুপ্ত হয়ে গেছে, সাংবাদিকতার স্বাধীনতা অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়েছে যার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে অনেক নিরপেক্ষ ন্যায়পরায়ন সাংবাদিক।এবার আমার এই লেখার হেডলাইন যে পড়সি নিতী তা নিয়ে চুড়ান্ত আলোচনা। আমরা গত প্রায় ১৬ বছর যাবৎ এদেশে বিভিন্ন নামের সাংবাদিক সংগঠন দেখেছি, যার বেশিরভাগ সংগঠনের বৈধতা বলে কিছুই ছিলোনা। আবার বৈধ বা অনুমোদন প্রাপ্ত, রেজিষ্ট্রেশনকৃত যে সকল সংগঠন ছিলো তাদের প্রায় অধিকাংশ সংগঠনের নেতৃত্বদানকারী সভাপতি, সাধারন সম্পাদক এবং সাংগঠনিক সম্পাদক আছে যাদের যোগ্যতা,কর্ম দক্ষতা, ন্যায়পরায়নতা, বস্তুনিষ্ঠ অভিজ্ঞতা এবং সত্যবাদিতা একদম নেই বল্লেই চলে। বিশেষকরে সাংবাদিক সংগঠনগুলোর ভিতরে সাধারন সাংবাদিকদের প্রতি সবসময়ই একধরনের বৈষম্য মূলক আচারন বিদ্যমান রয়েছে। কোন একটি সাংবাদিক সংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক হতে পারলেই অনেকে নিজেকে নিজে জ্ঞানীগুণী, মহাজনি ভাব, দাম্ভিকতা, অহমিকা ভর করে। যদিও আমি অনেক অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছি বা সারাদেশে বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছি এসব কথিত সাংগঠনিক নেতারা যেমন অনেকেই অযোগ্য, কর্মদক্ষতাহীন, চাটুকার,দলদাস, হিংসুক, নতজানু প্রকৃতির মানুষ। আর ঠিক ঐ শ্রেনীর সাংগঠনিক কথিত অযোগ্য দলদাস নেতাদের হাতে থাকতো কোন একটি রাজনৈতিক দলের চাবিকাঠি যা দিয়ে আর সকল সাধারন সাংবাদিকদের কলের পুতুল বানিয়ে রাখতো। সারা বাংলাদেশে বেশিরভাগ এসব অনৈতিক সাংগঠনিক নেতাদের কারনে একটি গর্বিত চতুর্থ স্তম্ভ কলঙ্কিত হয়েছে। সারাদেশের সংবাদ মাধ্যম থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, অবিশ্বাস আর দালালের সোপানে দাড় করিয়েছে সংবাদ মাধ্যম কে। সদ্য বিদায়ী সরকারের ২০২৪ সালে ৩মে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণায় বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম ছেঁড়া ফাটা নিকৃষ্টতম তলাবিহীন ঝুড়িতে ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। ১৮০ দেশের মধ্য ১৬৫তম স্থানে এবং এশিয়ার মধ্যে আফগানিস্তানের একটু ওপরে। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) তথ্যনুযায়ী বাংলাদেশ সাংবাদিকদের জন্য অন্যতম ঝুঁকিপূর্ন রাষ্ট্র, ১৪ জানুয়ারি ২০২৪ প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত। বাংলাদেশে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা রোধে শুধু যে সবসময়ই বিগত সরকার দায়ী তেমনটি নয়, ওসব অসৎ দলদাস সাংবাদিক নেতাদের পরামর্শে ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ৫৪,৫৫,৫৬,৫৭,৬৬ ধারা বিলুপ্তি করে বাংলাদেশ সংসদে কন্ঠো ভোটে ৩২ ধারায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করা হয় এবং এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দেশের বহু সাংবাদিক সরকারের হাতে নির্জাতন, নিপিড়ীন,জেল জরিমানার শিকার হয়েছে।
সর্বশেষ ৪৫ টাকা বেশি দামে কেনা লুঙ্গি ওয়ালা মনোভাবের সাংবাদিক নেতা আমাদের দেশের শত শত সাংবাদিক সংগঠনে এখোনো আছে। যে-সব কথিত সাংগঠনিক সাংবাদিক নেতা যাদের অনেকেরই য়োগ্যতা নেই, কর্মদক্ষতা নেই কিন্তু একই সংগঠন অনেক গুনী, যোগ্য, ন্যায়পরায়ন সাংবাদিক আছে তাদেরকে এখন থেকে আরসি পড়সি মনে করে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা থেকে বিরত থাকুন। একই সংগঠনের সকল সাংবাদিকদের একই পরিবারের সদস্য মনে করে যোগ্যদের প্রাধান্য দেয়া এবং নতুনদের যোগ্য করে তুলতে নির্মোহ ভুমিকা রাখুন। মনে রাখা উচিৎ যে আপনার ঈর্ষা, হিংসে, বিদ্বেষমূলক আচরণে কারো ন্যায়পরায়নতা যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা রুখে দেওয়া যায়না বরং একদিন তারা কঠোর প্রতিবাদী হয়ে ওঠে।
লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোঃ ফরহাদ হোসেন বাবু