1. [email protected] : b.m. altajimul : b.m. altajimul
  2. [email protected] : Gk Russel : Gk Russel
  3. [email protected] : Nazrul Islam : Nazrul Islam
  4. [email protected] : Md Salim Reja : Md Salim Reja
  5. [email protected] : Kamrul islam rimon : Kamrul islam rimon
  6. [email protected] : Torik Hossain Bappy : Torik Hossain Bappy
১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড: ঘটনার আগে, ঘটনার পরে - শিক্ষা তথ্য
সোমবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:৪৭ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম :
সাংবাদিকের গলায় জুতোর মালা; বিএমএসএফ’র তদন্ত কমিটি গঠন ; তিনদিনের মধ্যে বিচার দাবি রূপগঞ্জে গাজী টায়ারসে লুটপাটকারি ৭ জনকে ভ্রাম্যমান আদালতের কারাদন্ড প্রধান শিক্ষকের দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ পটুয়াখালীতে ৩দিনব্যাপী কৃষি প্রযুক্তি মেলা উদ্বোধন সহকারী এটর্নি জেনারেল পটুয়াখালীর এ্যাড. রিয়াদ গলাচিপা-রাঙ্গাবালীতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্পীড বোটে যাত্রী পারাপার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ব্যাংক পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের আর্তনাদ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদৃষ্টি কামনা-মোহাম্মদ শাহজাহান আমতলীতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে এক নারীর মৃত্যু সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন ৭দিনের মধ্যে চালু করা না হলে বৃহত্তর আন্দোলন ঘোষণা করা হবে-বিএনপি নেতা বাচ্চু

১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড: ঘটনার আগে, ঘটনার পরে

সংবাদদাতা :
  • আপডেটের সময় : বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট, ২০২৪
  • ৫৪ বার দেখা হয়েছে
{"remix_data":[],"remix_entry_point":"challenges","source_tags":["local"],"origin":"unknown","total_draw_time":0,"total_draw_actions":0,"layers_used":0,"brushes_used":0,"photos_added":0,"total_editor_actions":{},"tools_used":{"remove":1},"is_sticker":false,"edited_since_last_sticker_save":true,"containsFTESticker":false}

শিক্ষা তথ্য: শুরু হল শোকের মাস আগস্ট। শোকের মাস এলেই আমরা ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারা হত্যা করেছিল, কেন হত্যা করেছিল কিংবা এর পিছনে কি ষড়যন্ত্র রয়েছে। এ নিয়ে গবেষণা এবং আলোচনা আরও বহুদিন অব্যাহত থাকবে। আমরা জাতির পিতার হত্যার বিচার পেয়েছি। কিন্তু হত্যার নেপথ্যে যে ষড়যন্ত্র এবং এই হত্যাকারীদের পিছনে যে কুশীলব তাদেরকে এখন পর্যন্ত চিহ্নিত করতে পারিনি। আগস্ট ট্র্যাজেডির স্বরূপ উন্মোচন করা বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনের জন্য জরুরি। এই বিবেচনায় শোকের মাসে বাংলা ইনসাইডারের থাকছে ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আজ আমরা আলোচনা করবো প্রধমা প্রকাশনের ‌‌‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও অক্তাক্ত ১৫ আগস্ট: স্মৃতিকথা দলিল গবেষণা’ বই থেকে সাবেক প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী নূরুল ইসলাম চৌধুরীর লেখা ‘১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড: ঘটনার আগে, ঘটনার পরে’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। তখনো পুরোপুরি ভোর হয়নি। আমার স্ত্রী দূরে গোলাগুলির শব্দ শুনে আমাকে জাগিয়ে দিলেন। বললেন, কী যেন ঘটছে। হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে আমি একটু স্বাভাবিক হয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম কিসের শব্দ, কোন দিক থেকে আসছে। এমন সময় ফোন বেজে ওঠে। আমি চমকে উঠি। ফোন উঠিয়েই ওপারে শুনতে পেলাম উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কণ্ঠস্বর। আমাকে বরাবর ‘চৌধুরী সাহেব’ ডাকতেন তিনি। উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘চৌধুরী সাহেব, বঙ্গবন্ধুর বাসায় কী হয়েছে? আপনি জানেন কিছু?’ আমি বললাম, ‘না।’ ‘বঙ্গবন্ধুকে নাকি হত্যা করা হয়েছে, আপনি আপনার বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত জানান’, এ কথা বলেই ফোন রেখে দিলেন তিনি।

আমি দ্রুত লাল টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর বাসায় ফোন করলাম। টেলিফোনের শব্দ হচ্ছে কিন্তু ফোন ধরছে না কেউ। প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে সামরিক বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য আমার ছিল সরাসরি যোগাযোগের বিশেষ টেলিফোন। আমি সেই টেলিফোনে প্রথম সেনাবাহিনীর প্রধান সফিউল্লাহর সঙ্গে কথা বললাম। টেলিফোন ধরেই জেনারেল সফিউল্লাহ বললেন, ‘স্যার, সর্বনাশ হয়ে গেছে! সামরিক বাহিনীর কিছু বিদ্রোহী সদস্য বঙ্গবন্ধুর বাসায় ট্যাংক নিয়ে আক্রমণ করে তাঁকে হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধু আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন, কিন্তু কিছু করার আগেই সব শেষ হয়ে গেছে।’ আমি বললাম, ‘আপনি অন্যান্য বাহিনীর প্রধানদের নিয়ে কী করছেন? আপনি কি বিদ্রোহ নির্মূল করবেন না? বিদ্রোহ নির্মূল করুন।’ সফিউল্লাহ আমাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘আধঘণ্টার মধ্যেই বিদ্রোহ নির্মূল করব। অন্য দুই বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গেও আলোচনা করেছি।’

জেনাবেল সফিউল্লাহর সঙ্গে কথা বলার পর উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে আমি ফোনে কথা বলি। আমি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে আশ্বস্ত করে বললাম, ‘স্যার, চিন্তা করবেন না। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বিদ্রোহ নির্মূল হয়ে যাবে।’ এর পরপরই আমি যোগাযোগ করি মন্ত্রী আবুল মোমেন সাহেবের সঙ্গে। আমার আশ্বাসবাণী শুনে তিনি বললেন, ‘কোথায় আছেন? আপনার বাহিনীর প্রধানগণ খুনিদের দ্বারা মনোনীত প্রেসিডেন্ট মোশতাকের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেছে।’

আমি তেমন রেডিও শুনতাম না। সেদিনও আমার শোনা হয়নি। মোমেন সাহেবের কথায় সন্দেহ হওয়ায় আমি সামরিক দপ্তরে যোগাযোগ করি। আমার কথা হয় ডিএফআই (সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ) প্রধান ব্রিগেডিয়ার রউফ ও চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের সঙ্গে। খালেদ মোশাররফ আমাকে বললেন, ‘খুনিরা ডালিমের নেতৃত্বে এসে চিফকে নিয়ে গেছেন। সফিউল্লাহ সাহেব প্রথমে আপত্তি করেছিলেন কিন্তু জেনারেল জিয়া ও আরও দু-একজনের পরামর্শে তিনি অন্য প্রধানগণের সঙ্গে যেতে রাজি হলেন। জেনারেল জিয়া নাকি বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু যখন নেই, তখন দুঃখ করে কী হবে? বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে আমাদের যাওয়াই উচিত।’ এ কথা শোনার পর আমি রেডিও খুলে মোশতাক সরকারের প্রতি সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের আনুগত্যের ঘোষণা শুনতে পাই। আমি স্তম্ভিত হয়ে পড়ি।

এসব খবর জানার পর আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করি। বের হতে গিয়ে দেখি, বাইরের গেট বন্ধ। সেনাবাহিনীর যারা আমার নিরাপত্তার জন্য বাসায় মোতায়েন ছিল, তারা আমাকে বলল, ‘ক্ষমা করবেন স্যার। এ বাসার কাউকে বের হতে দিলে আমাদেরও শেখ সাহেবের মতো পরিণতি ঘটবে।’ এ ঘটনায় আমি ও আমার পরিবারের লোকজন ভয় পেয়ে মানসিকভাবে অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। সারা দিন আর বাসা থেকে বের হতে পারিনি। আতঙ্কে ও মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে সারা দিন অভুক্ত অবস্থায় থাকতে হয়। এমনকি সাংসারিক বাজার করার জন্য কাজের লোককেও বাইরে যেতে দেওয়া হয়নি। ইতিমধ্যে আমি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের লোকজন এবং অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়েছি লাল টেলিফোনের মাধ্যমে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার লাল টেলিফোন ও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের বিশেষ টেলিফোন লাইনটি অকার্যকর হয়ে পড়ে। তবে নিচতলায় আমার বাসার অফিসের সাধারণ টেলিফোন লাইনটি চালু ছিল।

১৫ আগস্টের বিকেলে আমি ভীত আর চিন্তিত হয়ে বসে আছি। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে আসবে। এমন সময় সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য আমার বাসা ঘেরাও করে। ভেতরে প্রবেশ করে আমার খোঁজখবর নিতে নিতে তারা দোতলার দিকে উঠতে থাকে। আমি সিঁড়িতেই তাদের মুখোমুখি হই। আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা আমাকে নিচে আসতে বাধা দিচ্ছিল। আমি তাদের বললাম, ‘কোনো লাভ নেই, এতে সবার জীবন বিপন্ন হতে পারে।’ আমি সিঁড়ির নিচের দিকে সেনাদের পাশাপাশি বেসামরিক পোশাকে একজনকে দেখতে পেলাম। আমাকে দেখেই তিনি বললেন, ‘স্যার, ভয় নেই। নিচে নেমে আসুন, কথা আছে।’ নিচে নেমে আসতেই তিনি আমাকে বললেন, ‘আপনাকে বঙ্গভবনে যেতে হবে।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’ তিনি বললেন, ‘সামরিক বাহিনী ও প্রেসিডেন্টের নির্দেশ।’ তিনি আমাকে একটি তালিকা দেখিয়ে কয়েকজন মন্ত্রীর নাম দেখালেন, যাঁদের সবাইকে তিনি বঙ্গভবনে নিয়ে যাবেন। তখন আমার পরনে ছিল লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি। বেসামরিক পোশাকধারী লোকটির সঙ্গে যখন আমি কথা বলছিলাম, তখন সেনারা আমাকে ঘিরে ছিল। আমি পোশাক পাল্টানোর কথা বলতেই তিনি সামরিক বাহিনীর লোকজনের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার কথা বললেন। দুজন সেনাসহ তারা আমাকে ওপরে যাওয়ার অনুমতি দিল। দুজন সেনা আমার সঙ্গে শোয়ার ঘর পর্যন্ত গেল। আমি লুঙ্গি বদলে একটি পায়জামা পরে নিলাম। ততক্ষণে বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেছে। বেসামরিক কর্মকর্তা আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘আপনার কোনো ক্ষতি করা হবে না। বঙ্গভবন থেকে আবার ফিরে আসতে পারবেন।’

তালিকা অনুযায়ী যাঁদের বঙ্গভবনে নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে, তাঁদের মধ্যে সোহরাব সাহেব ও সৈয়দ আলতাফ হোসেন ছিলেন। আমাকে সঙ্গে নিয়েই সেনাবাহিনীর গাড়ি এ দুজনের বাসায় গেল। কিন্তু তাঁদের দুজনের কাউকেই বাড়িতে পাওয়া গেল না। এরপর আমরা গেলাম অধ্যাপক ইউসুফ আলীর বাসায়। আমি গাড়িতে বসে। কিছুক্ষণ পর ইউসুফ আলীকে যখন নিয়ে আসা হলো, তখন তিনি আমাকে গাড়িতে দেখে বললেন, ‘চৌধুরী সাহেব, ফিরে আসতে পারব তো?’ আমি বললাম, ‘জানি না।’ তাঁর পরিবারের লোকজন ততক্ষণে কান্নায় ভেঙে পড়েছে। তিনি জমজম কূপের পানি পান করে কাবা শরিফের গিলাফের একটি টুকরা আমার ও তাঁর মাথায় স্পর্শ করালেন। আমরা রওনা দিলাম বঙ্গভবনের দিকে।

বঙ্গভবনে পৌঁছানোর পরই দেখি, কালো পোশাকধারী সশস্ত্র লোকজন পুরো বঙ্গভবন ঘিরে রেখেছে। এই কালো পোশাকধারীদের মধ্যে সেনাবাহিনীর নিয়মিত সেনাদের পাশাপাশি ছিল সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যরাও। শপথ গ্রহণ শেষে বঙ্গভবনে মোশতাক সাহেব সবাইকে ডেকে বললেন, ‘শেখ মুজিবের লাশ টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে যাওয়া হবে। আপনারা কেউ যাবেন?’ উপস্থিত সবাই চুপ। কিছুক্ষণ পর আবদুল মান্নান সাহেব বললেন, ‘আপনি কি সত্যি এ কথা বলছেন? আপনি কি তা-ই চান?’ খন্দকার মোশতাক চুপ হয়ে গেলেন। সবাই অন্য রুমে চলে যাওয়ার পর আমাকে ইশারায় কাছে ডাকলেন মোশতাক। আমাকে বললেন, ‘মনে হচ্ছে তুমি মুজিবের খুব প্রিয় লোক ছিলে, তা না হলে কী করে তোমাকে প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী করল? সরকারের প্রধান ছাড়া আর কারও প্রতিরক্ষার দায়িত্বে থাকা উচিত নয়। কাল হতে তোমার দপ্তর হবে শিল্প, যা আগেও ছিল। প্রতিরক্ষার দায়িত্ব শুধু আমার।

শপথ গ্রহণের পর কথা হলো জেনারেল সফিউল্লাহর সঙ্গে। তিনি আমাকে বললেন, ‘বিদ্রোহ দমন নিয়ে আপনার সঙ্গে আমার যে কথা হয়েছে, তা কাউকে জানাইনি। বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কিছুই করতে পারিনি।’ সফিউল্লাহ সাহেব তখন তাঁর গলায় সব সময় একটি ছোট কোরআন শরিফ ঝুলিয়ে রাখতেন। কোরআন শরিফটি আমাকে দেখিয়ে বললেন, ‘আল্লাহর রহমতে বেঁচে গেছি।’

১৫ আগস্টের আগের ও পরের কিছু ঘটনা এখানে উল্লেখ করা জরুরি। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার ঠিক ২ মাস ২১ দিন আগে অর্থাৎ ২৫ মে আমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার কথা শুনি। সেদিন বঙ্গবন্ধু আমাকে তাঁর বাসায় ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘তোমাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিতে চাই।’ তিনি আরও বললেন যে এ ব্যাপারে তিনি কারও সঙ্গে কথা বলেননি এবং পরামর্শও করেননি। পরদিন ২৬ মে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমাকে শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী করা হয়। বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, সময়ের অভাবে তিনি প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা ও অভিযোগের প্রতি যথার্থ মনোযোগ দিতে পারেননি। এ কারণে আমাকে সশস্ত্র বাহিনীর সমস্যা, তাদের সাংগঠনিক কাঠামো ইত্যাদি বিষয় তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করতে হবে। এবং ৬ মাস পর আমাকে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে তিনি শুধু রাষ্ট্রপতি হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক থাকবেন।

আমার এই নিযুক্তিতে তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানগণ এবং বাহিনীর সবাই অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। কারণ, সবাই আশা প্রকাশ করেছিলেন যে তাঁদের অভাব-অভিযোগ ও অন্যান্য বিষয় আমার সঙ্গে আলোচনা করলে বঙ্গবন্ধু সাধ্যানুযায়ী সেসব সমাধানের চেষ্টা করবেন। প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে আমার নিযুক্তির পর তিন বাহিনীর পক্ষ থেকে তেজগাঁওয়ে বিমানবাহিনীর লনে আমাকে এক আন্তরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। দায়িত্ব গ্রহণের পর আমি সশস্ত্র বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো নির্ধারণের উদ্যোগ নিই। নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রধানগণের সঙ্গে আলোচনা ও পরামর্শ করে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর বিন্যাস ও কাঠামো চূড়ান্ত করি আমি। এই বিন্যাস ও কাঠামো বঙ্গবন্ধু অনুমোদন করার পর আমি তা কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু পদাতিক বাহিনীর কাঠামো ও বিন্যাস চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে দুই ধরনের মত ছিল। সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল সফিউল্লাহ চেয়েছিলেন ‘ডিভিশন কাঠামো’ আর জেনারেল জিয়া চেয়েছিলেন ‘ব্রিগেড কাঠামো’। যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর কাঠামো ও বিন্যাস চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি।

সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে সফিউল্লাহর নিযুক্তির ব্যাপারে প্রথম থেকেই সন্তুষ্ট ছিলেন না জিয়াউর রহমান। এ কথা আমি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের মুখ থেকেই শুনেছি অনেকবার। জিয়ার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ। আমি যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে চট্টগ্রাম শহর ত্যাগ করে আমার নিজস্ব এলাকা (১৯৭০ সালে বৃহত্তর পটিয়া থেকে আমি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলাম) পটিয়ায় চলে আসি, তখন আমাকে দক্ষিণ চট্টগ্রাম বিপ্লবী কাউন্সিলের সভাপতি করা হয়। আতাউর রহমান কায়সার আগরতলায় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ করে কিছু অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রামে চলে আসেন। আতাউর রহমান কায়সারের প্রস্তাবেই ৭ এপ্রিল আমাকে চেয়ারম্যান করে এবং সে সময়ের কক্সবাজারের এসডিও জনাব শুক্কুরকে সচিব করে প্রথম বিপ্লবী পরিষদ গঠিত হয়। সেই সময় থেকে ১৯৭১ সালের মে মাসে রামগড় পতনের পর ভারতীয় এলাকায় জিয়ার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল কয়েকবার। তা ছাড়া বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান সাহেব বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার প্রাথমিক ঘোষণার পর ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নামে মেজর জিয়া স্বাধীনতার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন থেকেই আমি তাঁকে জানতাম। স্বাধীনতা লাভের পর খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে নাখালপাড়ার এমপি হোস্টেলে আমি ৬-৭ মাস অবস্থান করেছিলাম। তখন জেনারেল জিয়া প্রায়ই আমার রুমে আসতেন এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। জেনারেল জিয়া প্রায়ই দুঃখ করে বলতেন যে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। জেনারেল সফিউল্লাহ ব্যাচমেট হলেও কৃতিত্বের দিক থেকে তিনি ওপরের দিকে ছিলেন। তাই সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানের পদটি তাঁরই পাওয়া উচিত ছিল। তারপরও সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে সফিউল্লাহর তিন বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাঁর আশা ছিল যে সেনাবাহিনীর প্রধান হবেন তিনি। কারণ, সেনাবাহিনীর প্রধানদের নিয়োগ প্রথা অনুযায়ী সাধারণত পুনর্নিয়োগ হয় না।

পদাতিক বাহিনীর কাঠামোবিন্যাস নিয়ে একদিন আমি প্রতিরক্ষাসচিব মজিবুল হক, জেনারেল সফিউল্লাহ এবং জিয়ার সঙ্গে আলোচনাকালেই খবর পাই যে বঙ্গবন্ধু সফিউল্লাহকে তিন বছরের মেয়াদ শেষে আরও তিন বছরের জন্য সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করেছেন। এটা জানার পর জিয়াউর রহমান অত্যন্ত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি আমার অফিসে এসে আমাকে তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করতে বলেন। প্রতিরক্ষাসচিব মজিবুল হককেও বিষয়টি জানান। আমি জিয়াউর রহমানকে দু-এক দিন অপেক্ষা করতে বলি এবং বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকে জানাই। সেদিন বঙ্গবন্ধু খুবই রেগে গিয়ে বললেন, ‘তুমি এখনই তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। তুমি জানো না, জিয়া অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী। সে অনেককে দিয়ে বাকশালের সদস্য হওয়ার জন্য আমার কাছে সুপারিশ করেছে। সে ধৈর্য ধরতে জানে না। আমি এখন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদেরই সদস্য করেছি, পরে হয়তো তাঁকেও করব।’ এ কথা শোনার পর আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম, ‘পদাতিক বাহিনীর কাঠামোবিন্যাসের জন্য জিয়াকে আমার আরও কিছুদিন দরকার। ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে আপনার আদেশের জন্য পাঠিয়ে দেব।’ এতে বঙ্গবন্ধু সম্মত হলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথোপকথনের সবকিছু না বলে আমি জিয়াউর রহমানকে জানালাম যে রাষ্ট্রপতি সফিউল্লাহর নিযুক্তির ব্যাপারে বর্তমানে কিছুই করতে চান না। আমি সেনাবাহিনীর কাঠামোবিন্যাস চূড়ান্ত করার জন্য পদত্যাগের আগপর্যন্ত জিয়ার কাছ থেকে সহযোগিতা কামনা করে বললাম, আগামী ১ সেপ্টেম্বর তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হবে। এতে জেনারেল জিয়া সম্মত হন।

১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ঘটার দু-তিন দিন আগে সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ সেনাবাহিনীর মধ্যে কিছু ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে আমাকে অবহিত করেছিলেন। আমরা বিষয়টি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করি। বঙ্গবন্ধুও মনে হয় গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানের কাছ থেকে আগে এর কিছু আভাস পেয়েছিলেন। ডিএফআইয়ের প্রধান ও আমার সঙ্গে আলোচনা করে বঙ্গবন্ধু সফিউল্লাহকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। কিন্তু কেন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না বা সম্ভব হয়নি, তা আমার এখনো অজানা। এর দু-তিন দিন পরই ঘটে এ দেশের ইতিহাসের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ।

১৫ আগস্টের আগের কিছু কথা তো বলা হলো। এবার আসা যাক ১৫ আগস্ট-পরবর্তী কিছু ঘটনায়। আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে জিয়াউর রহমান একদিন শিল্প ভবনে আমাকে ফোন করলেন। আমি তখন শিল্প প্রতিমন্ত্রী আর জিয়াউর রহমান তখন সেনাবাহিনীর প্রধান। আমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও জিয়াউর রহমান আমাকে বললেন, ‘স্যার, আপনি একটু সফিউল্লাহকে বুঝিয়ে বলুন। সে মানসিকভাবে অত্যন্ত বিপর্যন্ত। কারণ, তাকে সরিয়ে আমাকে সেনাবাহিনীর প্রধান করা হয়েছে।’ এরপর আমি সফিউল্লাহ সাহেবকে বলেছিলাম সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সবকিছু মেনে নিতে। সফিউল্লাহ সাহেব শুধু অনুযোগ করে বলেছিলেন, ‘আমাকে অত্যন্ত অপমানজনকভাবে কিছু না বলে এবং না জানিয়ে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।’

অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমি একটি সম্মেলনে যোগ দিতে বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়ায় যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যাই। এর কথাবার্তা আগেই হয়েছিল। ১৫ আগস্টের ঘটনার পর থেকে স্বাভাবিক কারণেই কোনো কিছুতে মন বসাতে পারছিলাম না। তাই আজমির যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম। সোফিয়ায় যাওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট মোশতাকের কাছ থেকে অনুমতি নিতে গেলে তিনি প্রথমে আপত্তি করেছিলেন। পরে আজমির শরিফেও যাব শুনে তিনি অনুমতি দেন।

আমার বিদেশ যাওয়ার এক দিন আগে সেনাবাহিনীর প্রধান জিয়াউর রহমান আমার বাসায় এসে হাজির। লে. জেনারেল (অব.) ওয়াসিউদ্দিন তখন ঢাকায়। জিয়াউর রহমান অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘মোশতাক জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনকে সেনাবাহিনীর প্রধান করতে চায়। আমার কাছে এই ষড়যন্ত্রের কথা আর গোপন নেই। আমি তাকে প্রয়োজনে লাথি মেরে বের করে দেব।’ এরপর জিয়াউর রহমান আমাকে বিদেশ যেতে বারণ করলেন। আমি তাঁকে আমার মানসিক অশান্তির কথা জানিয়ে বললাম, ‘আমাকে আজমির শরিফ যেতেই হবে।’ জিয়াউর রহমানের মোশতাকবিরোধী ভূমিকা লক্ষ করে আমি জেলখানায় আটক চার নেতার মুক্তির জন্য অনুরোধ করেছিলাম সেদিন। তিনি আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি প্রতিজ্ঞা করছি, তাঁরা সবাই মুক্তি পাবেন।’

আমি যখন অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায়, তখন ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা ও নভেম্বরের পাল্টা অভ্যুত্থানের কথা শুনি। এ অবস্থায় আমি সম্মেলনে যোগ না দিয়ে মস্কো চলে যাই। মস্কোতে অবস্থানকালেই আমি ৭ নভেম্বর আরেক অভ্যুত্থানের কথা শুনি। মস্কো থেকে দিল্লি এবং কলকাতা হয়ে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের প্রথম দিকে আমি ঢাকায় চলে আসি। মস্কোতে রাষ্ট্রদূতের বাসায় থাকার জায়গা ঠিক করা হয়েছিল। সেই সময়ের একটি ঘটনার কথা আমি আজও ভুলে যাইনি। তখন যিনি দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ছিলেন (নাম ইচ্ছা করেই গোপন করলাম, কারণ তাঁকে বিব্রত করতে চাই না) তিনি আমাকে মস্কো বিমানবন্দর থেকে রাষ্ট্রদূতের সরকারি বাসভবনে নিয়ে আসেন। রাতে তাঁর বাসায় আমার খাওয়ার নিমন্ত্রণ ছিল। তখন হঠাৎ তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ফোলা দাগ দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী হয়েছে?’ তখন তাঁর স্ত্রী বলেছিলেন, ‘ভাইকে সব ঘটনা খুলে বলো।’ তদানীন্তন দূতাবাসের সামরিক সচিবের সঙ্গে (পরে তিনি বিমানবাহিনীর প্রধান হয়েছিলেন’) সামরিক শাসন সম্বন্ধে তর্কাতর্কির কোনো এক সময় ঘুষি মেরে তিনি তাঁকে রক্তাক্ত, জখম করেন। আমি তখন বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর সামরিক বাহিনীর সহায়তায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকৃত সরকারের সামরিক বাহিনী বা আমলাতন্ত্রের ঔদ্ধত্যপূর্ণ কার্যকলাপের কী পরিণতি হবে, তা অনুধাবন করতে পেরেছিলাম।’

আমি ঢাকায় ফিরে আসার পর আমার স্ত্রীর কাছ থেকে জানলাম, জেনারেল জিয়া আমার খোঁজখবর নিয়েছিলেন এবং দ্রুত দেশে ফিরে আসতে বলেছিলেন। আমার ঢাকায় ফিরে আসার কয়েক দিন পর এক রাতে কারফিউ চলাকালে কর্নেল অলি আহমদ আমার সরকারি বাসভবন থেকে সদ্য স্থানান্তরিত মগবাজারের বাসায় এসে জানালেন, জেনারেল জিয়া আমাকে তাঁর ক্যান্টনমেন্টের বাসায় যেতে বলেছেন। প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলেও অলি সাহেবকে দেখে ভরসা পেলাম। কারণ, অনেক আগে থেকেই অলি আহমদকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। অলি সাহেব জেনারেল জিয়ার বাসায় আমাকে পৌঁছে দিয়ে চলে গেলেন। এবং কিছুক্ষণ পর এসে আমাকে বাসায় পৌছে দিয়ে গিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান আমাকে দেখেই আলিঙ্গন করে বললেন, ‘ভাগ্যের কারণে ও আল্লাহর রহমতে বেঁচে গেছি।’ আমি তখন জিয়াউর রহমানকে তাঁর ওয়াদার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে জেলখানা হত্যাকাণ্ডের কথা জিজ্ঞেস করি। জিয়াউর রহমান বললেন, ‘আমি যখন অবরুদ্ধ ছিলাম, তখন মোশতাকের নির্দেশে তাঁদের খুন করা হয়েছে। আমার কিছুই করার ছিল না।’ জিয়াউর রহমান তাঁর ড্রইংরুমে বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখিয়ে আমাকে বললেন, ‘আমি তাঁকে শ্রদ্ধা করি, কিন্তু কমিউনিস্ট ও তথাকথিত প্রগতির কথা শুনে তিনি বিপথে চালিত হয়েছিলেন।’

১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় ইতিহাসের কাঠগড়ায় আমি সব সময়ই নিজেকে অপরাধী মনে করি। আমার দুর্ভাগ্য, সে সময় আমি প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার একজন সদস্য ছিলাম। এই নৃশংস ও জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড যেহেতু সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্যের দ্বারাই সংঘঠিত হয়েছে, সে কারণে এর দায়ভার আমার ওপরও বর্তায়।

১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর সেদিন খন্দকার মোশতাকের প্রতি সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানগণ আনুগত্য প্রকাশ করায় আমি অত্যন্ত অসহায় এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। সেদিন সন্ধ্যায় মোশতাক আহমদের মন্ত্রিসভায় শপথ গ্রহণ করতে অনেকের সঙ্গে আমাকেও বাধ্য করা হয়েছিল। আমি নিজেকে দায়মুক্ত করার জন্য এত দিন পর এ লেখা লিখতে বসিনি। আমি নিজেকে আজও অপরাধী মনে করি। কারণ, সেদিন আমি মৃত্যুভয়ে ভীত ছিলাম। মৃত্যুকে মাথা পেতে নিতে পারিনি।

আমার মৃত্যুভয় ছিল, এ কথা স্বীকার করে নিয়েই বলছি, সশস্ত্র বাহিনীর গুটিকয়েক সদস্যের এই বিদ্রোহ দমনে আমার তেমন কিছুই করার ছিল না। আমি বেসামরিক ব্যক্তি। অস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আমার শক্তি ছিল সশস্ত্র বাহিনী। আমি সশস্ত্র বাহিনীকে নির্দেশও দিয়েছিলাম সেভাবে। সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ আমাকে আধঘণ্টার মধ্যে বিদ্রোহ দমনের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা করতে পারেননি। সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধান, বিডিআরপ্রধান, পুলিশপ্রধান ও রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধান, যাঁদের হাতে অস্ত্র দিয়ে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা সবাই আনুগত্য প্রকাশ করেছিল মোশতাক সরকারের প্রতি। কিছু খুনি ও সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্তৃক একটি দেশের স্থপতি রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা, একজন উচ্চাভিলাষী বেসামরিক ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ এবং সশস্ত্র বাহিনীসহ রাষ্ট্রের অন্য নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানগণের সেই অবৈধ রাষ্ট্রপতির প্রতি আনুগত্য প্রকাশের ঘটনা সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে আর ঘটেনি।’

আজ অনেকেই আমাদের সমালোচনা করেন, কেন আমরা সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ করেছিলাম। আমি আমার মৃত্যুভয়ের কথা স্বীকার করছি। কেউ সেদিন প্রতিবাদ করার সাহস দেখাননি। আমি ভয় পেয়েছিলাম কারণ, যারা নারী, শিশু, এমনকি অন্তঃসত্ত্বা নারীকেও নিষ্ঠুরভাবে পরিকল্পনামাফিক হত্যা করতে পারে, তারা কাউকেই রেহাই দেবে না। এমনকি রাষ্ট্রের কোনো বাহিনীও এদের প্রতিরোধে এগিয়ে আসেনি। এই খুনিদের অবাধ্য হওয়ার পরিণতি কী, তার প্রমাণ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী।

১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞের পর ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে গোপন বাসস্থান থেকে বের করে এনে প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করার জন্য খন্দকার মোশতাক পর্যন্ত অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন ঘৃণাভরে। এর আগে তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও কামারুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে জেলখানায় রাখা হয়েছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। খুনি রাষ্ট্রপতি মোশতাকের নির্দেশে এই জাতীয় চার নেতাকে পরে হত্যা করা হয় জেলখানায়। বাংলাদেশের আরেক পৈশাচিক ঘটনা হচ্ছে এই জেলাহত্যা। আমার এখনো মনে আছে, খন্দকার মোশতাক বঙ্গভবনে সংসদ সদস্যদের এক সভা ডেকেছিলেন। সেদিনের সভায় অস্ত্র নিয়ে পাহারা ছিল আমাদের পেছনে। খুনি বাহিনীর সদস্যরা সংসদ সদস্যদের ওপর নজর রাখছিল অস্ত্র হাতে। মনে পড়ে, সেই বৈঠকে একমাত্র ময়েজউদ্দিন আহমেদ ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দ উচ্চারণ করে প্রতিবাদী বক্তব্য রেখেছিলেন। সংসদ সদস্য সিরাজুল হকও নরম ভাষায় প্রতিবাদ করে খন্দকার মোশতাক আহমদকে সাংবিধানিক বৈধতার কথা বলেছিলেন। আর কেউ সেদিন কোনো কথা বলার সাহস পাননি। এমনকি অনেক সংসদ সদস্যকে সেদিন খন্দকার মোশতাকের স্তুতি-কীর্তন করতেও শুনেছি।

আমরা বেসামরিক নাগরিক, মৃত্যুকে ভয় পাই না-এ কথা বলা অন্যায় হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের সশস্ত্র বা নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ও সদস্য যাঁরা, তাঁদের তো ভয় পাওয়ার কথা নয়। প্রয়োজনে মৃত্যুকে গ্রহণ করার মতো দৃঢ় মানসিকতা তো তাঁদের থাকার কথা। কিন্তু আমাদের সশস্ত্র ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যগণ সেই সাহসটুকু দেখাতে পারেননি। এখনো মনে আছে, খন্দকার মোশতাক সরকারের মন্ত্রিসভায় শপথ গ্রহণের পর আমাদের প্রিয় ফণীভূষণ মজুমদার দুঃখ করে আমাকে বলেছিলেন, ‘যৌবনে মৃত্যুভয়হীন বিপ্লবী রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও বৃদ্ধ বয়সে জীবনকে ভালোবেসে মৃত্যুকে গ্রহণ করতে পারলাম না।’ ফণীভূষণ মজুমদারকে হাসপাতাল থেকে অসুস্থ অবস্থায় বঙ্গভবনে এনে শপথ গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছিল। ফণীভূষণ মজুমদার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারেননি, আমিও পারিনি।

১৫ আগস্ট শুধু বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারবর্গ, শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর স্ত্রী, আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তাঁর পরিবারবর্গের সদস্য এবং কর্নেল জামিলকেই কেবল হত্যা করা হয়নি, সেই সঙ্গে হত্যা করা হয়েছিল আমাদের সাহস ও প্রতিবাদ করার ক্ষমতাকেও।

নুরুল ইসলাম চৌধুরী: প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা; বঙ্গবন্ধু সরকারের সাবেক প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী।

আপনার সামাজিক মিডিয়া এই পোস্ট শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরো খবর

নামাজের সময়সূচী

  • ফজর
  • যোহর
  • আছর
  • মাগরিব
  • এশা
  • সূর্যোদয়
  • ৪:২৮
  • ১২:০০
  • ৪:২৬
  • ৬:১৬
  • ৭:৩১
  • ৫:৪১
শিক্ষা তথ্য পত্রিকার কোন লেখা, ছবি বা ভিডিও কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: সাইবার প্লানেট বিডি