বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে এর আগেও হয়তো তিনি কথা বলেছেন। এবারও বললেন, দিলেন অভিমত। হয়তো একারণেই তিনি শিরোনাম হয়েছেন অতিতের মতই। নতুন করে হওয়া শিরোনাম বলছে- জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে নিজের অভিমত দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান। বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের সরকার খ্যাত অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণাপত্র পাঠ করার পর তিনি এক ফেসবুক পোস্টে দেয়া অভিমতে লিখেছেন, ১. এই ঘোষণাপত্রে তুলে ধরা ইতিহাসের বেশির ভাগ অংশ একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ নিয়ে বর্ণনা অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট ও একতরফা। যাঁরা আওয়ামী লীগকে ঘৃণা করেন, এতে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে। এই ঘৃণা দলটি সরকারে থাকাকালে যা করেছে শুধু সে জন্য নয়; বরং দলটি সম্পর্কে তাঁদের মনোভাবের জন্য এটাকে একটি রাজনৈতিক বৈরিতা বলা যায়। ঘোষণাপত্রের অনেকটাই পড়ে মনে হয়, যেন এটি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের বিরোধী ও সমালোচকদের লেখা একটি রাজনৈতিক বক্তব্য।
চলমান সময়ের রাজনৈতিক কর্মকা-কে সামনে নিয়ে হয়তো তিনি নিবিড়ভাবে ভেবেছেন, যেই ভাবনায় আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা কেবল হাবুডুবু খাচ্ছিলাম ভেবেই হয়তো ডেভিড বার্গম্যান একটু আগবাড়িয়ে এসে স্বেচ্ছায় লিখেছেন- ২. সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে এই ঘোষণাপত্রে যে রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক বয়ান তুলে ধরা হয়েছে, তা ১৯৭১ সালের যুদ্ধ নিয়ে আওয়ামী লীগ যে রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক ইতিহাস ব্যবহার করেছিল, তার চেয়ে বেশি সমস্যাজনক হতে পারে। আওয়ামী লীগের সময়েই তাদের ওই ইতিহাস নিয়ে (দলটির সমালোচনাকারীরা) কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। এই ঘোষণাপত্র অতিমাত্রায় পক্ষপাতদুষ্ট ও রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক একটি ইতিহাসের বর্ণনাকে সরিয়ে, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক আরেকটি বর্ণনাকে প্রতিষ্ঠা করছে। কে জানত, ৫ আগস্ট আসলে সেটি নিয়েই ছিল। ৩. ইতিহাসের এই বয়ানে নিচের বিষয়গুলো উপেক্ষা করা হয়েছে, ত্রুটি রয়েছে এবং ভুল উপস্থাপনা করা হয়েছে।’
বার্গম্যান যখন নির্মম সত্য তুলে ধরে লিখেছেন- ‘ত্রুটি রয়েছে এবং ভুল উপস্থাপনা করা হয়েছে।’ তখন নতুন প্রজন্মের রাজনীতি সচেতন নাগরিক হিসেবে বলতেই পারি যে, জাতি হিসেবে বরাবরই আমরা রাজনীতিকে ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে নির্মাণ করার কারণে নেমে এসেছে চরম পরাজয়-দুঃসময়। এই পরাজয় আর দুঃসময় থেকে দেশের মানুষকে বাঁচানোর কোনো ইচ্ছে যদি আপনার থাকে, তাহলে একটু আওয়াজ তুলুন-লিখুন অথবা বলুন সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে-দুর্নীতি-খুন-ধর্ষণ-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে থাকার কথা। যে যুদ্ধ কলমের হবে, বাংলাদেশকে ভালোবেসে সাহসের হবে। সেই সাহসযুদ্ধের প্রেরণা আপনিও পেতে পারেন নির্ভীক সাংবাদিক ডেভিড-এর অভিমতের পুরোটা পড়লে, যেখানে তিনি লিখেছেন- ‘ঘোষণাপত্রে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনকালকে শুধু একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশালের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। যুদ্ধপরবর্তী জাতি গঠনে আওয়ামী লীগ যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করেছিল, সেগুলো উপেক্ষা করা হয়েছে। (অনুচ্ছেদ ৪) এতে বরং ১৯৭১–পরবর্তী ‘জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার’ দায় ‘সংবিধানের খসড়া তৈরির প্রক্রিয়া ও কাঠামোর দুর্বলতার’ ওপর চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে আওয়ামী লীগের যতটা সফল হওয়ার কথা ছিল, ততটা না হওয়ার পেছনে নিঃসন্দেহে অনেক কারণ রয়েছে। তবে আমি কখনোই শুনিনি, সংবিধানের ‘খসড়া তৈরি’ ও ‘কাঠামো’ সেসব কারণের একটি। (আমার মনে হয়, ‘সংবিধান নিয়ে’ এই বিতর্ক উঠে এসেছে বিশেষ একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কাছ থেকে। বাংলাদেশে তারা এখন ক্ষমতাশালী এবং নতুন একটি সংবিধানকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য কারণ খুঁজে বের করতে চায়)। ঘোষণাপত্রে ১৯৭৫ সালের আগস্টে সেনাসদস্যদের হাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের ১৬ জন সদস্যের হত্যার কথা উল্লেখ করা হয়নি। এই হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে বছরের পর বছর ধরে সামরিক শাসন শুরু হয়েছিল। (অনুচ্ছেদ ৪) ঘোষণাপত্রে ১৯৭৫ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত মুজিব–পরবর্তী সময়ে যখন জিয়াউর রহমান (যিনি পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতা হন) ক্ষমতায় ছিলেন, ওই সময়টাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। আর এটাকে সাধারণভাবে তুলে ধরা হয়েছে ‘সিপাহি-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব’ হিসেবে, যা ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তনের’ পথ সুগম করেছিল (অনুচ্ছেদ ৪)। এটি সেই সময়ের অতিমাত্রায় বিএনপিপন্থী বর্ণনা। ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘১/১১’—যখন ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সরিয়ে সামরিক বাহিনী–নিয়ন্ত্রিত সরকার এসেছিল, তা ছিল ‘ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থার’ ফল (অনুচ্ছেদ ৬)। প্রকৃতপক্ষে এটি হয়েছিল বিএনপি সরকার যখন নির্বাচনে কারচুপি করার চেষ্টা করছিল। আর এই কারচুপি থামানোর একমাত্র পথ ছিল সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ। দৃশ্যত সে সময় এ সিদ্ধান্ত খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।’
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যারা মারা গেছেন, তাদের জাতীয় বীর এবং আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা পাবে আইনি সুরক্ষা। এছাড়া এই ঘোষণাপত্র সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত থাকবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকার ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্রে। ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিমিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ ৫৪ বছর পরও যখন নির্মমভাবে ভয়াহব আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে একের পর এক। তখন নতুনধারার রাজনীতিক হিসেবে বরাবরই চেয়েছি- বাংলাদেশে সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন, ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ, আইনের শাসন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত হোক। কিন্তু তা কি হবে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের দ্বারা ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্রের দ্বারা। সংবিধান ও সকল রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক সংস্কারের কথাও রয়েছে জুলাই ঘোষণাপত্রে থাকলেও তা কতটা আলোর মুখ দেখবে, তা নিয়ে আমি যখন চিন্তিত; তখন সেই একই চিন্তা উঠে এসেছে বার্গম্যানের অভিমতে ঠিক এভাবে- উল্লেখ করা হয়েছে যে ১/১১–এর পেছনের ‘ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থা’ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছিল (অনুচ্ছেদ ৬ ও ৭)। তবে ২০০৯ সালের নির্বাচনে কিছু কারচুপির ঘটনা ঘটলেও এই নির্বাচনকে সাধারণত বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনগুলোর একটি হিসেবে দেখা হয়। সে সময় স্পষ্টভাবেই আওয়ামী লীগ ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় দল (২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি তাদের সুনাম হারিয়েছিল)। ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল তা উল্লেখ না করে ঘোষণাপত্রে এই ধারণা দেওয়া হয়েছে যে ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে দলটি ‘ফ্যাসিবাদী, অগণতান্ত্রিক ও গণবিরোধী’ ছিল (অনুচ্ছেদ ৭)। এটি একেবারেই অসত্য। বাস্তবতা হলো, ক্ষমতায় থাকার সময় যতই গড়িয়েছিল, ততই অগণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। ৪. ঘোষণাপত্রে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনকালকে সম্পূর্ণরূপে একটিমাত্র দিক দিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ধরনের উপস্থাপন কোনো বৈধ নথির চেয়ে সাধারণত বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রচারণামূলক লেখায় দেখা যায়।’
বাংলাদেশ শুধুই কি ক্ষমতাসীনদের দ্বারা পরিচালিত হবে? জনগণের কোনো অংশগ্রহণ থাকবে না দেশ পরিচালনায়? এমন অনেক প্রশ্নের সাথে সাথে এগিয়ে যেতে যেতে দেখলাম, তিনি বলেছেন- আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কালের বর্ণনা দিতে গিয়ে ঘোষণাপত্রে এই বিশেষণগুলো ব্যবহার করা হয়েছে: ‘গণবিরোধী’, ‘স্বৈরাচারী’, ‘মানবাধিকারবিরোধী’, ‘মাফিয়া ও ব্যর্থরাষ্ট্র’, ‘সীমাহীন দুর্নীতি’, ‘ব্যাংক লুট’ এবং অনুসরণ করা নীতিগুলো ‘প্রাণবৈচিত্র্য ও জলবায়ুকে বিপন্ন করছে’। এই বর্ণনাগুলোর কয়েকটি অবশ্যই সত্য। কিন্তু ঘোষণাপত্রে আওয়ামী লীগের অন্য আরেকটি দিক পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, নারীশিক্ষা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং প্রকৃতপক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্য অর্জন করেছিল তারা। আওয়ামী লীগ সরকারে থাকাকালে একই সঙ্গে দুটি বয়ানই ছিল। তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ইতিবাচক বয়ানগুলোকে ছাড়িয়ে যায় নেতিবাচক বয়ান। ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়েছে (অনুচ্ছেদ ১১): ‘যেহেতু শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনসহ সমাজের সর্বস্তরের জনগণ গত প্রায় ষোলো বছর যাবৎ নিরন্তর গণতান্ত্রিক সংগ্রাম করে জেলজুলুম, হামলা-মামলা, গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়।’ ঘোষণাপত্রে বর্ণনা করা এসব ঘটনা ঘটেছিল, তবে এখানে যেভাবে অতিরঞ্জিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, সেভাবে ঘটেনি। ৫. এই ঘোষণাপত্রে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া মতামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেটি অন্তবর্তী সরকারকে বৈধতা দিয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে (অনুচ্ছেদ ২০)। তবে আমার জানামতে, স্বাক্ষরকৃত ওই আদেশ কেউ দেখেননি। এ থেকে বিচারকেরা আদৌ কখনো স্বাক্ষর করেছেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।’
একজন বিদেশী সাংবাদিক হয়েও তিনি বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে কেন ভেবেছেন? এই প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না। তবে বুঝি- জাতি হিসেবে আমরা পরাজিত হয়েছি ব্রিটিশদের কাছে, একাত্তরের পরে বিভিন্ন সময় ষড়যন্ত্রকারীদের কাছে। হয়তো সেই সুযোগটাই নিয়েছেন তিনি; বসেছেন ‘গায় মানে না আপনি মোড়ল’ স্টাইলে উপদেষ্টার আসনে। সেই আসনে বসেই তিনি নিজের মত করে অভিমতের নামে দিয়েছেন নিজস্ব নির্দেনা। যেমন তিনি লিখেছেন- ৬. যদিও এটা ঠিক যে ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে ‘আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্র ও জনতাকে’ ভবিষ্যতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার শিকার হওয়া থেকে একধরনের ‘আইনি সুরক্ষা’ দেওয়া উচিত (অনুচ্ছেদ ২৪), তবে শব্দের ব্যবহার দেখে মনে হয়েছে আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মী ও পুলিশ কর্মকর্তাদের হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দায়মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে (যে পরিস্থিতিতে সেই হত্যাকা-গুলো ঘটুক না কেন)। ‘আইনের শাসনের’ দিক দিয়ে এখানে সমস্যা রয়েছে, যে আইনের শাসন বাংলাদেশের মানুষ আশা করে বলে ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। ৭. ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে (অনুচ্ছেদ ২৭)।’ এমন একটি ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতমূলক দলিল যদি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তবে তা অবশ্যই লজ্জাজনক হবে। ৮. ঘোষণাপত্রের কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে।’
এই ইতিবাচক বা নেতিবাচক কথাগুলোকে কেউ মনে না রাখলেও আমি মনে রাখবো কেবল বাংলাদেশকেই নয়; বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের এই কষ্টসময়কেও। যেখানে দাঁড়িয়ে তারা বাঁক স্বাধীনতা হারাচ্ছেন প্রতিদিন-প্রতিক্ষণ। গণমাধ্যম দখল হয়ে যাচ্ছে যখন তখন। এমন একটা পরিস্থিতিতে তাঁর অভিমতে আমি ব্যাপক বাঁক খুজে পেয়েছি। যেমন তিনি প্রথম বাঁকে একটু নিরপেক্ষতা বজয়া রাখলেও পরবর্তীতে তাঁর অজান্তেই নিয়েছেন কোনো একটি পক্ষ। যে পক্ষ যুদ্ধাপরাধী-স্বাধীনতা বিরোধী বা বাংলাদেশ বিরোধী হিসেবে বরাবরই নিন্দিত। ১৯৭১- কে জাতির ইতিহাসে ন্যায্য স্থান দিয়েছে এবং বলেছে যে লড়াইটি ছিল একটি ‘উদার গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রের জন্য (অনুচ্ছেদ ১ ও ২)। এটি আন্দোলন ও অভ্যুত্থানকে বেশ নির্ভুলভাবে বর্ণনা করেছে। এটি বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে ভালোভাবে তুলে ধরেছে। এতে বলা হয়েছে, তারা ‘সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন, আইনের শাসন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এবং সব রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধনের’ অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে (অনুচ্ছেদ ২২)। একই সঙ্গে ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি, শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন ও মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে’ (অনুচ্ছেদ ২৫)। এটি সঠিকভাবে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীসহ বিভিন্ন পক্ষের হাতে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ‘প্রায় এক হাজার’। ৯. সব মিলিয়ে, এটা উল্লেখযোগ্য যে অধ্যাপক ইউনূস, যিনি দলীয় রাজনীতিতে জড়িত না থাকার সুবিধাজনক অবস্থান থেকে অন্তবর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিতে এসেছিলেন, তিনি এই ঘোষণাপত্রে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে সম্মত হয়েছেন। কে জানে নির্বাচনের পর অধ্যাপক ইউনূসের জন্য কী ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। তবে অনেকের মতে, এই ঘোষণাপত্রে তাঁর সম্পৃক্ততা তাঁর এককালের উজ্জ্বল ভাবমূর্তির কফিনে পেরেক ঠুকে দেওয়ার মতো হবে।’
খুব কৌশলে হেঁটে চলা জাতি বাংলাদেশীরা নয়। যে কারণে নবাব সিরাজকে পরাজিত হতে হয়েছে, তিতুমিরকে প্রাণ দিতে হয়েছে, শরীয়তুল্লাহকে থমকে যেতে হয়েছে, প্রীতিলতাকে বেছে নিতে হয়েছে আত্মস্বীকৃত মৃত্যু, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা বা সাবেক রাষ্টপতি জিয়াউর রহমানকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে দেয়া হয়েছে নির্মম মৃত্যুও পরিণতি। কিন্তু ব্রিটিশসহ প্রায় সকল পশ্চিমা দেশের মানুষেরাই কৌশলী এাঁ বার্গম্যানের অভিমত-এর শেষ লাইন-ই জানিয়ে দেয়। সবাই খুশি হয় এমনভাবে তিনি লিখেছেন- ১০. এই ঘোষণাপত্র আরও সংক্ষিপ্ত হতে পারত। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ নিয়ে ১ ও ২ নম্বর অনুচ্ছেদ ছাড়া এই ঘোষণাপত্রে আর কোনো রাজনৈতিক ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করা উচিত হয়নি।’
এতে করে বাম-ডান-মধ্যপন্থি কেউ আর বার্গম্যানের উপর রাগ করতে পারবে না বলেই তিনি ভেবেছেন। কিন্তু জনাব বার্গম্যান আপনি জানেন না হয় তো যে, জাতির মধ্যে দু-একজন হলেও এমন থাকে, যারা রাজনীতি যেমন বোঝে, তেমনই বোঝে রাজনীতির মারপ্যাঁচও…
তবে, আমি মনে করি রাজনীতির নামে মানুষকে বোকা যেন কেউ আর না বানাতে পারে সেই বিষয়ের কোনো নির্দেশনা না থাকায় আশাহত হয়েছে ছাত্র-যুব-জনতার একটি বড় অংশ। শুধু ১ হাজার শহীদ আর আহতদের জন্য বার্তা না থেকে থাকতে পারতো ‘জুলাই অপরাধী’দের তালিকা প্রকাশ, চেতনা বিক্রি করে যেন কেউ রাজনীতি করতে না পারে, সেই বিষয়েরও দিক নির্দেশনা। যা না থাকায় আমাদের রাজপথকে কলুষিত করার লাইসেন্স নিয়ে আবারো হাজির হবে বাংলাদেশ বিরোধী-দুর্নীতিবাজ-চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসী-ধর্ষক-খুনী ও তাদের ধারক-বাহকেরা…