আসিফ জামান, ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি:ন্যায়বিচারের পথ সাধারণ মানুষের জন্য যত কঠিন ছিল, ঠাকুরগাঁওয়ের লিগ্যাল এইড সেই পথটাকে দিনে দিনে সহজ করে তুলছে। আদালতের মামলার জট কমানো, সুলভ ও দ্রুত সেবা নিশ্চিত করা, আর আইনকে মানুষের ঘরে ঘরে পৌছে দেওয়া এই লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৭ সালে যাত্রা শুরু করা লিগ্যাল এইড এখন জেলার অসহায় মানুষের কাছে নির্ভরতার এক আলাদা ঠিকানা।
গত ২৮ বছরের দীর্ঘ পথচলায় ঠাকুরগাঁও জেলা লিগ্যাল এইড অফিস যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। অফিসে নতুন দায়িত্ব নেওয়ার পর লিগ্যাল এইড অফিসার (সিনিয়র সহকারী জজ) মো. মজনু মিয়া কার্যক্রমকে তরান্বিত করেছেন। অভিযোগপত্র জমা থেকে শুরু করে সমাধান পর্যন্ত সব প্রক্রিয়ায় স্পষ্ট গতি এসেছে। আগে যেখানে খুব কম মানুষ এই সেবার কথা জানতেন, এখন ইউনিয়ন থেকে জেলা শহর পর্যন্ত লিগ্যাল এইডকে কেন্দ্র করে সচেতনতার ঢেউ উঠেছে।
বিচারপ্রার্থীদের আস্থা বাড়াতে লিগ্যাল এইড অফিস নানা পেশাজীবী সংগঠন, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সরাসরি সভা-সেমিনার করছেন। সরকারি খরচে আইনি সহায়তা, নতুন আইন বাস্তবায়নে সুবিধা, স্বল্প সময়ে বিরোধ নিষ্পত্তি এসব বিষয় উঠে আসে প্রতিটি আলোচনায়। মানুষ বুঝতে পারছেন, ন্যায়বিচারের দরজা তাদের জন্য বন্ধ নয়।
কার্যালয়ের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৫২২ জন মানুষ বিনা খরচে বিচারিক সহায়তা পেয়েছেন। দায়ের হওয়া ৫৭৮ অভিযোগের মধ্যে ৪৪০টি নিষ্পত্তি হয়েছে মধ্যস্থতার মাধ্যমে। সরকারি খরচে মামলা দায়ের হয়েছে ১১১টি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, মধ্যস্থতা ও সমঝোতার মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের হাতে পৌছেছে প্রায় ৫৪ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ। জমি-জায়গা নিয়ে পুরনো ঝামেলায় পড়া কয়েকজনও মাঠ পর্যায়ে এসে নিজের প্রাপ্য জমি পেয়েছেন।
জেলার সব ৫টি উপজেলায় লিগ্যাল এইড কমিটি সক্রিয় হয়েছে, ৫৪টি ইউনিয়নেও কমিটি গঠন করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত সচেতনতার আলো পৌছে গেছে সর্বত্র। এই প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে আইনের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ছে, আর মামলাজটও কিছুটা হলেও কমছে। ঠাকুরগাঁওয়ের সাধারণ মানুষ এখন জানেন, আইনের সহায়তা মানে জটিলতা নয়, সঠিক দরজায় কড়া নড়লেই সমাধান হাতের নাগালে।
সম্প্রতি আয়োজিত সরকারি খরচে আইনি সহায়তা বিষয়ক সেমিনারে বক্তারা জানান, অনেক মানুষের জন্য আইনি সহায়তায় সবচেয়ে বড় বাধা হলো ব্যয়, দীর্ঘসূত্রতা ও জটিলতা। এসব দূর করতে লিগ্যাল এইড কার্যক্রম বাস্তব সমাধানের পথ তৈরি করেছে। সমাজের প্রান্তিক মানুষের সামনে যে দরজা দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল, এখন সেটি অনেকটাই উন্মুক্ত।
সেমিনারে একটি মানবিক ঘটনার উদাহরণ তুলে ধরা হয় যা উপস্থিত সবাইকে নাড়া দেয়। ৩৫ বছরের বৈবাহিক সম্পর্ক থাকা এক দম্পতির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা ভুল-ধারণা এবং পারিবারিক বিরোধ সন্তানদের মা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। লিগ্যাল এইড অফিসে অভিযোগ দায়েরের পর মধ্যস্থতার মাধ্যমে মা সন্তানদের ফিরে পান কোনো খরচ ছাড়াই।
জমির মালিক পারুল বেগম বলেন, কয়েক বছর ধরে জমি নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝামেলা চলছিল। লিগ্যাল এইড অফিস আমাদের সবাইকে ডেকে সব কথা শুনল এবং সঠিকভাবে বাটোয়ারা নির্ধারণ করল। মনে হলো অবশেষে মাথার ওপরের বোঝাটা নেমে গেল। আমরা ন্যায্যটাই পেয়েছি। অন্য আরেক মালিক ইমদাদুল হক বলেন, আমরা নিজে যতই সমাধান চেয়েছিলাম, মাঝপথে সমস্যা তৈরি হতো। লিগ্যাল এইড অফিস মাঠে নেমে সব হিসাব-নিকাশ করে সীমানা ঠিক করল। এখন দুই পক্ষই নিশ্চিন্ত।
জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন বলেন, সরকারি খরচে লিগ্যাল এইড সেবা দরিদ্র ও অসহায় মানুষকে আইনের দোরগোড়ায় পৌছে দিচ্ছে। শুধু মামলা সমাধান নয়, মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসা হচ্ছে, যা সমাজে শান্তি বজায় রাখতে সাহায্য করছে।
সেবা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঠাকুরগাঁও জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার মো. মজনু মিয়া বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য সাধারণ মানুষকে বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা দেওয়া। কেউ যদি আর্থিক কারণে মামলা চালাতে না পারে, আমরা সরকারি খরচে আইনজীবী নিযুক্ত করি এবং আপসের মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসা করি। আমরা জমি-বিরোধ, পারিবারিক বিরোধ যেমন দেনমোহর, ভরণপোষণ এবং আপসযোগ্য ফৌজদারি মামলা সমাধান করি।
তিনি আরও বলেন, সরেজমিনে গিয়ে নথি-সাক্ষ্য যাচাই করে উভয় পক্ষের সঙ্গে বসে সমাধান করি। এভাবে মানুষের মধ্যে আইনের প্রতি আস্থা বাড়ে, বিরোধ কমে, এবং দরিদ্র মানুষও তাদের অধিকার রক্ষা করতে পারে।