সঞ্জয় ব্যানার্জী, পটুয়াখালী প্রতিনিধি।। নদীর ওপর ঝুলছে সেতু। কিন্তু সেই সেতু কাজে আসছে না। ১৫০ফুট সেতুর অংশ বিশেষ ধ্বসে পড়ায় তা ব্যবহার হচ্ছে না। সেই সেতু পার হতে হচ্ছে খেয়া নৌকায়। তাতে সময়-অর্থ দুটোই অপচয় হচ্ছে। সেতু ধ্বসের দুই মাস পেরিয়ে গেছে। সংস্কারের উদ্যোগ না নেয়ায় চরম ঝুঁকি নিয়ে মনিরাদের নদী পারাপার হতে হচ্ছে। মনিরারা জানেন না কবে নাগাদ খেয়া নৌকা ছেড়ে সেতু দিয়ে স্কুলে যাতায়াত করতে পারবে। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মনিরা আক্তার। লেখাপড়া করছে পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার বেতাগীসানকিপুর ইউনিয়নের খারিজা বেতাগী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। স্কুলে যেতে প্রতিদিনই মনিরাকে ছোট্ট একটি খেয়া নৌকায় চরম ঝুঁকি নিয়ে নদী পারাপার হতে হয়। কারন এলাকার জমির মৃধা সেতুটির ভেঙে নদীতে পরায়, তাদের এ দুর্ভোগ। শুধু মনিরার মতো স্কুল শিক্ষার্থীরাই নয় সেতুটি ভেঙে পরায় তাদের ইউনিয়ন দুই ভাগে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছে। ৭বছর ৩মাস আগে সেতুটি বিধ্বস্ত হলেও এখনও মেরামত কিংবা নতুন করে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেই। এঅবস্থায় ইউনিয়নবাসি উপজেলার সঙ্গে সহজ যোগাযোগ, লেখাপড়া, জরুরী স্বাস্থ্য সেবাসহ সকল কার্যক্রম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পরেছে। ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় সূত্র জানায়, বেতাগী সানকিপুর ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সুতাবড়িয়া শাখা নদী। নদীর পূর্ব পাড়ে মরদানা, গরমআলী, জাফরাবাদ গ্রামসহ খারিজাবেতাগী ও তফালবাড়ীয়া গ্রামের একাংশ। আর পশ্চিমপাড়ের গ্রামগুলো হচ্ছে রামবল্লভ, দাবাড়ি, চিংগরীয়া, চন্দ্রাবাজসহ খারিজাবেতাগীর এবং তফালবাড়ীয়ার অপর অংশ। এই ১১ গ্রামবাসির সহজ যোগাযোগ সংযোগ ছিল জমির মৃধা বাজার এলাকার খারিজা বেতাগি মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন লাহার বিমের উপর আরসিসি কংক্রিট ঢালাইর এই সেতু। পূর্ব পাড়ের লোকজন নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার-হাট, জরুরী স্বাস্থ্য সেবার কমিউনিটি ক্লিনিক, মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার জন্য পশ্চিম পাড়ে আসতে হয়। অপরদিকে পশ্চিম পাড়েরর লোকজনদের সরাসরি উপজেলা সদরে যোগাযোগে এই সেতু পার হয়ে যেতে হতো। এলজিইডি দশমিনা উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় জানান, ইউনিয়নবাসির সহজ যোগাযোগের জন্য দশমিনার উপজেলার ঠাকুরের হাট সংলগ্ন পরিত্যাক্ত লোহার সেতুটি সড়িয়ে এনে বেতাগী সানকিপুর ইউনিয়নের জমির মৃধা বাজার এলাকায় স্থাপন করা হয়েছিল। ২০১৪- ২০১৫অর্থ বছরে এ সেতু স্থাপন করতে ব্যয় হয় ১০লাখ টাকা। লোহার বিমের উপর আরসিসি কংক্রিট ঢালাইর ১৫০ফুট লম্বার এই সেতুর মাঝখানে প্রায় ২৫ফুট অংশ ভেঙে নদীতে পড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে দুই পাড়ের মানুষজন। গতকাল রোববার সকালে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়ে পাঠদান নিতে শিক্ষার্থীরা ছোট্ট একটি ডিঙ্গি খেয়া নৌকায় নদী পাড় হচ্ছে। এই শিক্ষার্থীরা নদীর পূর্ব পাড়ের বাসিন্দা। এরা পশ্চিমপাড়ের খারিজা বেতাগী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। ওই বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মনিরা আক্তার বলেন, ইউনিয়নের একমাত্র মাধ্যমিক স্কুল। সেতু ভেঙে পরায় এখন তাদের এলাকার শিক্ষার্থীদে এখন ঝুঁকি নিয়ে নদী পাড় হয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে। খারিজা বেতাগী গ্রামের নাসির উদ্দিন ওই বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। সে জানায়, ছোট্ট নৌকায় নদী পার হতে খুব ভয় করে তাদের। তারপরও লেখাপড়ার জন্য কষ্ট করে স্কুলে আসতে হচ্ছে। জাফরাবাদ গ্রামের সুমাইয়া ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। সুমাইয়া জানায়, এখন আর প্রতিদিন তার স্কুলে আসা সম্ভব হচ্ছে না। বাড়ি থেকে একা স্কুলে পাঠাতে চায় না। সুমাইয়া প্রতিদিন স্কুলে আসতে চায়। খারিজা বেতাগী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. হিরন আহমেদ বলেন, খারিজা বেতাগী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৩শ’ শিক্ষার্থী ও খারিজা বেতাগী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ২শ’ শিশু শিক্ষার্থী রয়েছে। এদের মধ্যে অন্তত দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী নদীর পূর্ব পারের বাসিন্দা। সেতুটি বিধ্বস্ত হয়ে পরায় এখন শিশু শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার কমে গেছে। সেতুটি যখন ভেঙে পরেছিল তখন একটি শিশু মারা গিয়েছিল। এখন শিক্ষার্থীরা ছোট্ট খেয়া নৌকায় পারাপার হচ্ছে। এতে করে সবসময় আমাদের একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়, কোন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটল কিনা। এদিকে স্কুল থেকে দক্ষিন দিকে একটু হেটে জমির মৃধা বাজারে গিয়ে দেখা যায় খারিজা বেতাগী কমিউনিটি ক্লিনিক। একজন রোগী সেখানে সেবা নিচ্ছেন। কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ কেয়ার প্রভাইটর ফারিয়া সুলতানা জানায়, ইউনিয়নে দুইটি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এর মধ্যে একটি দশমিনা-পটুয়াখালী সড়কের ঠাকুরের হাট এলাকায় আপরটি এই জমির মৃধা বাজারে। এখানে এক সময় প্রচুর রোগি আসত। বিশেষ করে গর্ভবতী মা ও শিশুর সংখ্যাই ছিল বেশি। সেতুটি ভেঙে পরার পর এখন নদীর পূর্ব পারে নারী-শিশু রোগী খুব কমই আসছে। খেয়া নৌকায় নদী পার হয়ে গর্ভবতী মা ও শিশুদের আসা-যাওয়া চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পরায় রোগির সংখ্যা অনেক কমে গেছে বলে জানান তিনি। বাজারের ব্যবসায়ী মো, জাহাঙ্গীর মেলকার বলেন, সেতুটি ভেঙে পরার পর বাজারে ব্যবসা বানিজ্যে ভাটা পরেছে। পূর্ব পারের মানুষ তাদের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় মালামায় কিনতে সরাসরি বাজারে চলে আসতো। কিন্তু এখন তেমন লোকজন আসে না। ওই পারের লোকজন উপজেলা সদরে চলে যাচ্ছে। বেতাগিসানকিপুর ইউপি চেয়ারম্যান মসিউর রহমান ঝন্টু বলেন, আসলে সেতুটি ভেঙে পরায় আমার ইউনিয়ন এখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছে। পুরোনো সেতু স্থাপন করা হলেও মজবুত ছিল না। এখন নতুন করে একটি সেতুর জন্য দশমিনা উপজেলা পরিষদ, এলজিইডি কার্যালয়ে অবহিত করা হয়েছে। এলজিইডি দশমিনা উপজেলা প্রকৌশলী মকবুল হোসেন বলেন, বালু ভর্তি কার্গোর ধাক্কায় লোহার সেতুটি বিধ্বস্ত হয়। তবে এখন আর সেখানে লোহার সেতু নির্মাণ সঠিক হবেনা। এছাড়াও সেতু স্থানে নদী ভাঙ্গন, তাই স্থান পরিবর্তন করে আরসিসি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মাটি পরিক্ষা করে দেখা যায় ব্রিজ নির্মানের উপযোগী নয় স্থান।
উল্লেখ্য, পটুয়াখালীর দশমিনার খারিজা বেতাগি মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন সুতাবাড়য়িা শাখা ন;ীর উপর লোহার সেতুটি ১৪ডিসেম্বর দুপুরে ভেঙে পরে। বালু বোঝাই একটি কার্গোর ধাক্কায় সেতুর মাঝখানের অংশ ভেঙ্গে নদীতে পরে যায়। এসময় সেতুর উপর থাকা চার শিশুসহ পাঁচজন নদীতে পরে যায়। চারজন সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও নুরসাত জাহান (৫) নামে একটি শিশু নিখোঁজ হয় এবং ঘটনার পাঁচদিন পর সেতু ভেঙে পরার স্থান থেকে নুরসাতের মরদেহ ভেসে উঠে। এঘটনায় পুলিশ কার্গোর চালক, হেলাপারকে আটক করেছে এবং একটি মামলা দায়ের হয়েছে।