রাকিব হোসেন মিলনঃ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম জনবহুল রাষ্ট্র। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫৭ লাখ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এত বিশাল জনসংখ্যা এবং জনসংখ্যার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির ফলে আমাদের দেশে দিন দিন বর্জ্য উৎপাদনের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আমাদের পরিবেশের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। বাংলাদেশে শহরগুলোয় গ্রামের তুলনায় জীবনযাপনের সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকায় দিন দিন মানুষ জন শহরমুখী হয়ে উঠছে ক্রমাগত। আতংকের বিষয় হলো শহরাঞ্চলে বর্জ্য উৎপন্নের পরিমাণ গ্রামের তুলনায় অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজধানী ঢাকা পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর এবং বসবাস অযোগ্যতার দিক থেকে ঢাকার অবস্থান চতুর্থ। ঢাকার কথা যদি বাদ ও রাখি, দেশের অন্য বড় শহরগুলোর অবস্থাও অনেকাংশে একই। অতিরিক্ত পরিমাণ জনসংখ্যার চাপ ও মানবসৃষ্ট বর্জ্য ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি, শহরগুলোর পরিবেশকে অবসবাসযোগ্য করে তুলেছে। সুপরিকল্পিত ও সুনির্দিষ্ট বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে দেশের বিভিন্ন শহরাঞ্চলের পরিবেশমানের উন্নতি ও বিভিন্ন সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে।
অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেরও বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা অনুন্নত। যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলে রাখা, অপরিকল্পিত ময়লার স্তূপ, বর্জ্য সংগ্রহের লোক স্বল্পতা, অনুন্নত বর্জ্য পরিবহন ব্যবস্থা এবং বর্জ্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার সমন্বয়হীনতা ও জবাবদিহিতার অভাব দেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আসল তথ্য। এটি সুস্পষ্ট বর্জ্য অব্যবস্থাপনা ও অরাজকতার দৃশ্যমান লক্ষ্মণ। দেশে বর্জ্য সৃষ্টির পরিমাণ প্রতি বছর প্রায় ২৩০ লাখ টন, যা দিন দিন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমরা যদি বর্জ্যগুলোকে বর্জ্য না ভেবে সম্পদ ভাবতে পারি তাহলে হয়তো বা এভাবে যেখানে-সেখানে বর্জ্য ফেলে পরিবেশকে ঝুঁকির মাঝে ফেলার প্রবণতা কমে আসবে। বর্জ্যগুলোকে সম্পদে পরিণত করতে পারলে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে। বাংলাদেশের উৎপন্ন বর্জ্যরে বেশিরভাগই হচ্ছে গৃহস্থালির বর্জ্য, বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক বর্জ্য, বাণিজ্যিক বর্জ্য, কারখানার বর্জ্য, রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বর্জ্য প্রভৃতি। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশে বিদ্যমান বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে বর্জ্য সংরক্ষণ, সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ এবং ল্যান্ডফিলের (ভাগাড়) ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর ব্যবস্থাপনার অনুসরণ করা যেতে পারে। টেকসই উন্নয়নে দেশের বর্তমান বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নিন্মেরর পদক্ষেপগুলো ফলপ্রসূ হতে পারে।
বর্জ্য সংরক্ষণ: বর্জ্য যেখানেই উৎপন্ন হোক না কেন, তা যথাযথভাবে নির্দিষ্ট স্থানে সংরক্ষণের অভ্যাস সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অতি গুরুত্বপূর্ণ। উৎসের ওপর ভিত্তি করে সঠিকভাবে সংগ্রহের জন্য বর্জ্যকে পৃথক করতে হবে। এক্ষেত্রে বর্জ্যকে তার উপাদানের ওপর ভিত্তি করে আলাদাভাবে রাখা যেতে পারে। যেমন প্লাস্টিক বর্জ্য, কাগজের বর্জ্য, কাপড় জাতীয় বর্জ্য, ধাতব বর্জ্য, রান্নার বর্জ্য ইত্যাদি। বর্জ্য আলাদাভাবে সংরক্ষণের জন্য গৃহস্থালি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বর্জ্যের উপাদানের ওপর ভিত্তি করে আলাদা ময়লার ঝুড়ি, ব্যাগ রাখতে হবে এবং নির্দিষ্ট ঝুড়ি বা ব্যাগে নির্দিষ্ট ময়লা ফেলতে হবে।
আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণ ময়লা রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়, যা একই সঙ্গে পরিবেশ দূষণ করে এবং বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ময়লার পরিমাণ কমাতে একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর ঢাকনাযুক্ত ডাস্টবিন রাখতে হবে। অনেক ক্ষেত্রেই ডাস্টবিনের ঢাকনা না থাকার ফলে ভেতরের ময়লা পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া খোলা ডাস্টবিনের ময়লা-আবর্জনা থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়, যা বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ।
এছাড়া স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ মেডিকেল বর্জ্য যেমনঃ ব্যবহৃত সুঁই, সিরিঞ্জ, তুলা, ব্যান্ডেজ, রক্ত, স্যালাইনের ব্যাগ প্রভৃতি আমাদের দেশে সাধারণ ডাস্টবিনেই ফেলা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আলাদা ডাস্টবিন এবং আলাদা সংগ্রহ পদ্ধতি থাকা প্রয়োজন।
বর্জ্য সংগ্রহ: বর্জ্য সংরক্ষণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি তা নিয়মিত গৃহস্থালি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ডাস্টবিন থেকে সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করতে হবে এবং এ কাজের জন্য দক্ষ ও পর্যাপ্ত লোকবল নিয়োগ দিতে হবে। আমাদের দেশে বর্তমানে ঢাকাসহ বিভিন্ন সিটি করপোরেশন ও বড় বড় শহরাঞ্চলগুলোয় নিয়মিত বর্জ্য সংগ্রহের জন্য ইতোমধ্যে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা শুনা গেলেও দক্ষ পরিচালনা ও লোকবলের অভাবে অনেক সময়েই নিয়মিত বর্জ্য সংগ্রহ করায় ব্যর্থতা দেখা যায়। মনে রাখতে হবে, সংরক্ষিত বর্জ্য যথাসময়ে যদি অপসারিত না করা হয় তবে তা পরিবেশে ছড়িয়ে গিয়ে পরিবেশ দূষণের কারণ হবে। এছাড়া ডাস্টবিনে জমে থাকা ময়লা থেকে পরিবেশে বাজে দুর্গন্ধ ছড়ায়, বিভিন্ন ধরনের রোগজীবাণুবাহী কীটপতঙ্গ যেমনঃ মশা, মাছি, ইঁদুর প্রভৃতির উৎপত্তি ঘটে। তাই বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে গতিশীল রাখতে বর্জ্য নিয়মিত সংগ্রহের বিকল্প নেই
বর্জ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করতে হবে। স্থানীয় পরিচ্ছন্ন কর্মীরা বাসা থেকে বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সামনে সংরক্ষিত ময়লা, ময়লার ট্রাকে সংগ্রহ করবে। সাধারণত যানবাহন ও জনসমাগম যখন কম থাকে যেমন মধ্যরাত অথবা ভোরের সময় তখন বর্জ্য সংগ্রহ করতে হবে। এতে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ সহজ হবে এবং জনস্বাস্থ্যের ক্ষতির সম্ভাবনা কম থাকবে।
কিছু বর্জ্য রয়েছে, যা পরিবেশে খুবই মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। যেমন তেজস্ক্রিয় বর্জ্য, রাসায়নিক বর্জ্য, মেডিকেলের বর্জ্য, বিভিন্ন প্রকারের বাণিজ্যিক কাজে অব্যবহৃত রং, ই-বর্জ্য প্রভৃতি। এই বর্জ্যগুলো আমাদের দেশে যত্রতত্রভাবে নিষ্কাশিত হচ্ছে, যার ফলে দেশের জনসাধারণের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ উভয়ই হুমকির সম্মুখীন। এসব বর্জ্যকে বিশেষভাবে সংরক্ষণের আওতায় আনতে হবে এবং যে জায়গায় সংরক্ষিত ও নিষ্কাশিত করা হবে তার বাইরে স্পষ্টভাবে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ চিহ্ন ব্যবহার করতে হবে।
প্রক্রিয়াকরণ: সংগৃহীত বর্জ্যকে সরাসরি ভাগাড়ে নিয়ে ফেলা যাবে না। এই বর্জ্যগুলো থেকে পুনরায় পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্যকে আলাদা করতে হবে। বাংলাদেশের মোট বর্জ্যের প্রায় ৬০ শতাংশ পঁচনশীল। বিশেষ প্রক্রিয়ায় এই পচনশীল বর্জ্যকে কম্পোস্টিং করার মাধ্যমে বর্জ্যকে জৈব সারে রূপান্তরিত করা সম্ভব; যা কৃষিজমির জন্য খুবই উপকারী এবং এটি ব্যবহারে রাসায়নিক সারের মতো বিরূপ কোনো প্রভাব নেই। অপচনশীল বর্জ্যকে আবার পুনরায় ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য, দাহ্য বর্জ্য, অদাহ্য বর্জ্য হিসেবে আলাদা করে যেসব বর্জ্য পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী সেগুলোকে ‘রিসাইক্লিং’-এর আওতায় আনতে হবে। (উন্নত দেশগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কম্পোস্টিং আর রিসাইকেলিং দুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কম্পোস্টিংয়ের মাধ্যমে অনেক দেশেই সার উৎপাদনের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপন্ন করা হচ্ছে। এছাড়া রিসাইকেলকৃত পণ্যের চাহিদা বহির্বিশ্বে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি বর্জ্যরে পরিমাণও কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে অনেক জায়গায়ই বিদ্যুতের অপর্যাপ্ততা রয়েছে। পচনশীল বর্জ্য ব্যবহার করে কম্পোস্টিং করার মাধ্যমে এ সমস্যা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা যেতে পারে। পাশাপাশি বর্জ্যের পরিমাণ কমাতে আর বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে সহজ রাখতে হলে দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে আধুনিক রিসাইকেলিং কারখানাও স্থাপন করতে হবে।
অপচনশীল বর্জ্যের মধ্যে যেগুলো দাহ্য বর্জ্য রয়েছে, সেগুলোকে পুড়িয়ে ফেলা যাবে। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যেন দাহ্য বর্জ্যের সঙ্গে অবশিষ্ট অদহনশীল অংশ পোড়ানো না হয়।
ভাগাড়ে সংরক্ষণ : এর অবস্থান লোকালয় থেকে দূরে হওয়া বাঞ্ছনীয় এবং জনসাধারণের প্রবেশাধিকার হতে হবে সংরক্ষিত। একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর ল্যান্ডফিলের বর্জ্যকে পোড়াতে হবে। বর্জ্যকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় আনার পর তা থেকে যে অবশিষ্টাংশ থেকে যায়; তাই মূলত ল্যান্ডফিলে নিয়ে ফেলার উপযোগী বর্জ্য। অথচ আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বর্জ্য সংগ্রহের পরেই তা নিয়ে সরাসরি ল্যান্ডফিলে ফেলে দেয়া হয়।
অনেক সময় এই ময়লার স্তূপ থেকে পচনপ্রক্রিয়ার ফলে দূষিত পানি উৎপন্ন হয়। তাই ল্যান্ডফিল তৈরির আগে ওই স্থানের ভূগর্ভস্থ পানির অবস্থান এবং ভাগাড়ের সঙ্গে কোনো ধরনের পানির উৎসের সংযোগ রয়েছে কি না, তা খেয়াল রাখতে হবে।
টেকসই উন্নয়নের জন্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পিত পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়নের পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে ছোটবেলা থেকেই শিশুদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সচেতনতা প্রচারের মাধ্যমে শিশুসহ সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে।
উন্নত দেশগুলোয় বর্জ্যকে সম্পদের সঙ্গে তুলনা করা হয়। কারণ সেখানে বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য বিভিন্ন পণ্যে রূপান্তর করার পাশাপাশি তা থেকে কৃষিজমির সার, বিদ্যুৎ, গ্যাস উৎপন্ন করা হয়। ফলে সেখানে বর্জ্য হয়ে উঠেছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অন্যতম একটি নিয়ামক। আমাদের দেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে টেকসই উন্নয়নের জন্য পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে পারলে বর্জ্যই সম্পদ হয়ে উঠবে এবং বর্জ্যরে পরিমাণও অনেকাংশেই কমবে।
এছাড়া বর্জ্যরে ফলে যে পরিবেশ দূষণ হয় তা অনেকাংশে কমে আসবে এবং দেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষিত হবে। তাই সবদিক বিবেচনা করে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের পরবর্তী প্রজন্মকে দূষণমুক্ত, নিরাপদ ও সুস্থ-সুন্দর পরিবেশের বাংলাদেশ আমরাই নির্মাণ করে দিতে পারি।