যখন সারাদেশে সহিংসতা বাড়ছে তখন ‘পুরান ঢাকার ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে মো. সোহাগ হত্যাকাণ্ডে আসামিদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করবে না বলে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বার ইউনিটের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম।’ এমন সংবাদকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ট্রিটমেন্টে প্রকাশ করেছে দৈনিক গণমাধ্যমগুলো। এমন সময়েই ঘটে গেলো মাইলস্টোন ট্রাজেডির মত ভয়ংকর একটি ঘটনা। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বরাবরের মত সোহাগ হত্যার এই ঘৃণ্য নৃশংসতার তীব্র নিন্দা যেমন জানিয়েছি, ঠিক তেমনি নির্মম মাইলস্টোন ট্রাজেডির সুষ্ঠু তদন্তও প্রত্যাশা করছি, চাইছি মৃত্যূর সঠিক তথ্য দেয়া হোক; সেই সাথে সোহাগের হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের অনতিবিলম্বে গ্রেফতার ও বিচার নিশ্চিত করার জন্য যেন সংশ্লিষ্টরা উদ্যেগ নেয়, সেই লক্ষ্যে এই লেখার সূচনা।
একটা বিষয় মনে রাখতে হবে- মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে সোহাগ হত্যার সিসি ফুটেজে স্পষ্টভাবে সবকিছু দেখার পরও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সমস্ত দায়ভার বাংলাদেশের সবচেয়ে নিপীড়িত দল বিএনপির ওপর চাপানো হচ্ছে। ২০০৭ থেকে ২০২৪ সালের আগষ্ট পর্যন্ত এ দেশের সবচেয়ে নির্যাতিত, নিপীড়িত, অত্যাচারিত ও মজলুম মানুষের মুক্তি আসেনি ২০২৪-এর আন্দোলনের পরও। পতিত ফ্যাসিবাদীদের পথ ধরে নতুন সরকারের সময় এসে গত ১১ মাস ধরে জনগণকে নিরব করতে এমন কোনো অত্যাচার ও নিপীড়ন নেই যা করেনি। সর্বশেষ গত ১৩ জুলাই ময়মনসিংহের ভালুকায় একই পরিবারের তিনজনকে গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।
নিহতরা হলেন- নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার সেনের বাজার গ্রামের রফিকুল ইসলামের স্ত্রী ময়না বেগম (২৫), তার মেয়ে রাইসা বেগম (৭) ও ছেলে নিরব (২)। একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেই চলেছে, কারণ আইনের শাসন নেই, বিচারের সংস্কৃতি নেই। গত ৫৩ বছরের মত ৫ আগস্টের পর থেকে গত ১১ মাসে শুধুমাত্র আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় ৫ হাজারেরও বেশি মানুষ সহিংসতার শিকার হয়ে প্রাণ দিয়েছেন। লক্ষাধিক চুরি-ছিনতাই-ডাকাতি ও হানাহানির ঘটনা ঘটেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে ২ হাজার ৭ শত নিহতর ঘটনার সংবাদ প্রকাশ করলেও প্রকৃত সংখ্যা ৫ হাজারেরও বেশি বলে আমি একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে মনে করি।
অথচ অপরাধের হার বৃদ্ধি নিয়ে সম্প্রতি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়ের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে অপরাধ বৃদ্ধি নিয়ে একটি পোস্ট করা হয়েছে। ওই পোস্টে ২০২০ সাল থেকে ২০২৫ সালের অপরাধ চিত্র তুলে ধরে আগের অপরাধ আর নিজেদের আমলের অপরাধকে তুলনা করার মধ্য দিয়ে ব্যর্থতা ঢাকতে চেষ্টা করছে। যদি দেশকে- দেশের মানুষকে এই অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টরা সত্যি-ই ভালোবাসতেন, তাহলে লে-আউট না করে আইনের শাসন-বিচারের সংস্কৃতি তৈরি করে অপরাধ দমনে ভূমিকা রাখতেন। তা না করে অপরাধের সাথে অপরাধের তুলনা কোনো ভালো কাজ না।
যে কাজটি গণমাধ্যমের সামনে এসে ‘সংবাদ সম্মেলন’ করে বলা যেতো, সে কাজটি তারা সোস্যাল মাধ্যমে জানিয়েছে- ‘অপরাধের হার মারাত্মকভাবে বেড়েছে এমন নয়। বাস্তবতা হলো- সবচেয়ে গুরুতর কিছু অপরাধ কমে এসেছে বা স্থিতিশীল রয়েছে। মাত্র কয়েকটি অপরাধের ধরণ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। নাগরিকদের সতর্ক থাকা উচিত। একইসঙ্গে বিশ্বাস রাখা উচিত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধ দমনে কাজ করছে। ওই পোস্টে দুটি ছবি অপরাধ হারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ওই ছবিগুলোতে সবশেষ পাঁচ বছরের অপরাধের হার উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পরের ১০ মাসে অর্থাৎ, ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত খুনের ঘটনা ঘটেছে তিন হাজার ৫৫৪টি। ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৬১০টি।
দস্যুতা এক হাজার ৫২৬, দাঙ্গা ৯৭, ধর্ষণ চার হাজার ১০৫, এসিড নিক্ষেপ পাঁচ, নারী ও শিশু নির্যাতন ১২ হাজার ৭২৬, অপহরণ, ৮১৯, সিঁধেল চুরি দুই হাজার ৩০৪ ও সাত হাজার ৩১০টি চুরির ঘটনা ঘটেছে। এ ১০ মাসে অপরাধের বিপরীতে মামলা হয়েছে এক লাখ ৪৪ হাজার ৯৫৫টিটি। একই সময়ে পুলিশ হামলার শিকার হয়েছে ৪৭৯ বার। ২০২০ সালের পরিসংখ্যান তুলে ধরে ওই পোস্টে বলা হয়, বছরটিতে খুনের ঘটনা ঘটেছে তিন হাজার ৫৩৯টি। এছাড়া, ডাকাতি ৩০২, দস্যুতা ৯৭৮, দাঙ্গা ১৩, ধর্ষণ ছয় হাজার ৫৫৫টি এসিড নিক্ষেপ ১৬টি, নারী নির্যাতন ১৩ হাজার ৪৩১টি, শিশু নির্যাতন দুই ৫১৫টি চুরি সাত হাজার ২০০টি ও দুই হাজার ৫৩৩টি সিঁধেল চুরির ঘটনা ঘটেছে।
ওই বছরটিতে মামলা হয়েছে এক লাখ ৮৭ হাজার ৯২৬টি। পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে ৪৪৯ বার। ওই পোস্টে আরও বলা হয়, ২০২১ সালে তিন হাজার ২১৪টি, ২০২২ সালে তিন হাজার ১২৬টি, ২০২৩ সালে তিন হাজার ২৩টি ও ২০২৪ সালে চার হাজার ১১৪টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। বছরগুলোতে সর্বমোট মামলা হয়েছে সাত লাখ ৬৯ হাজার ৮৩৯টি।’ অপরাধ দমন করতে না পেরে অতিত অপরাধ দিয়ে তুলনা করা মানেই যে পরাজয়; তা হয়তো প্রেস সচিব বা বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান পিআর কর্তারা জানেন না। যদি জানতেন, তাহলে সবার আগে ৮ আগস্টে শপথ নেয়ার পর বাংলাদেশের মানুষকে শান্তি দেয়ার লক্ষ্যে শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসকে প্রশংসার পানিতে না ভাসিয়ে কঠোরভাবে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর হওয়ার জন্য নিবেদন করতেন।
শান্তিতে নোবেলজয়ীকে বাংলাদেশের মানুষ শান্তি পাওয়ার প্রত্যাশায় প্রধান উপদেষ্টা করার সিদ্ধান্তের সাথে সহমত পোষণ করেছিলো। কিন্তু সেই শান্তি আজ জাহান্নামের পথে হাঁটতে শুরু করেছে কেবলমাত্র অদক্ষ-অযোগ্য রাষ্ট্রনায়ক ড. ইউনূস আর তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে-অপরিকল্পিত পদক্ষেপের কারণে। একটু পেছনে ফিরে গেলে দেখবো- বৈষম্য দূর করার স্লোগান দিয়ে ক্ষমতাসীনদের পতন নিশ্চিত করা সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি অংশ শুধুমাত্র ক্ষমতায় আসবার লক্ষ্যে নতুন করে কোটা প্রথা চালু করেছে, নতুন দল গঠন করেছে তাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় থেকে সরে গিয়ে। এদের একটি অংশ স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্ব-জাতীয় সঙ্গীত-পতাকা-সংবিধানসহ অনেক কিছুই ধ্বংস করে হলেও ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে চাইছে।
কিন্তু জুলাই আন্দোলন কেন হয়েছিলো? তার উত্তর না দিয়ে বৈষম্যময় আগামী গড়তে দলীয় অন্ধত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে ছিনতাই-চুরি-ডাকাতি-খুন-হানাহা
খুবই কষ্ট পেয়েছি, যখন দেখেছি- ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ৩৩০ দিনে দেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর ২ হাজার ৪৪২টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ওই সব সহিংস ঘটনার মধ্যে রয়েছে হত্যা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্মীয় উপাসনালয়ে ভাঙচুর, ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গ্রেফতার, জোর করে বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখল, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা, জোর করে পদত্যাগ প্রভৃতি। সবচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে গত বছরের ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত, ২ হাজার ১০টি। এছাড়া গত বছরের ২১ আগস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩২টি সহিংসতার ঘটনা ঘটে। চলতি বছরের শুরু থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত নতুন করে আরও ২৫৮টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় সহিংসতার শিকার হয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ ও কিশোর-কিশোরীরা।
এরই মধ্যে অবশ্য সরকার বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে অনেকগুলো সংস্কার কমিশন গঠন করেছে এবং তাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে বেশকিছু সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্টও পেশ করা হয়। আমি ভেবেছিলাম- সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান বৈষম্য ও নিপীড়নগুলো চিহ্নিত করে তা অবসানের লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপের সুপারিশ করার জন্য আলাদাভাবে একটি সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা হবে। কিন্তু ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য কোনও আলাদা কমিশন গঠন করা হয়নি। পরে যেসব কমিশন গঠন করা হয়েছে সেখানেও ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের মধ্য থেকে কোনও প্রতিনিধি রাখা হয়নি।
এমনকি সংবিধান সংস্কার কমিশনেও কোনও সংখ্যালঘু প্রতিনিধি নেই। কারণ কি? কারণ নির্মম হলেও সত্য তাদেরকে অন্তবর্তী সরকার অতিতের সকল সরকারের মত করে বঞ্চিত শ্রেণি হিসেবেই রাখতে চায়। শুধু এখানেই কি শেষ! মাজার ভেঙেছে ছাত্রদের সরকার প্রধানখ্যাত ড. ইউনূসের সরকারের নিরবতার সুযোগে তথাকথিত শিক্ষার্থী আর তৌহিদী জনতা। তার উপর আবার নতুন দল বা শিক্ষার্থীদের দলের এক নেতা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আরো জোড়ালো প্রমাণ দিয়েছে যে, জাতির কল্যাণে, দেশের কল্যাণে নিবেদিত থাকবে না তারা।
তারাও অতিত ফ্যাসিস্টদের মত কেবলমাত্র রাজনীতি-ক্ষমতানীতি আর প্রতারণার রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে যেতে মেতে উঠতে চায় সহিংসতায়। হয়তো তাদের প্রেরণা আর ‘মবমারানি’ শব্দ উচ্চারণের কারণে দেশজুড়ে সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সবার আগে বাংলাদেশ। কথাটি ভুলে গিয়ে কেবলমাত্র রাজনৈতিক কারণে নির্মমতায় মেতে না উঠে আসুন নীতির সাথে উচ্চারণ করি- বাংলাদেশের অঙ্গিকার-সহিংসতা থাকবে না আর…