মোহাম্মদ আবুল হাশেম বান্দরবান প্রতিনিধি : বান্দরবান জেলার লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ক্যাশিয়ার আব্দুল ছত্তারের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। কর্তৃপক্ষ কার্যকরী কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় দিন দিন বেড়েই চলেছে তার অপকর্ম। এতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অতিষ্ট হয়ে উঠেছেন। তাই ক্যাশিয়ার আব্দুল ছত্তারের দ্রুত অপসারণসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবী জানান কর্মকর্তা কর্মচারীরা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২১ সালের ২১ ডিসেম্বর পাশের আলীকদম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে বদলি হয়ে লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ক্যাশিয়ার পদে যোগদান করেন আবদুল ছত্তার। চাকুরী জীবনের শুরুতে অফিস সহায়ক হিসেবে যোগদান করলেও পরবর্তীতে আওয়ামী দোসরদের ম্যানেজ করে তিনি ক্যাশিয়ার পদোন্নতি লাভ করেন। এরপর তিনি জড়িয়ে পড়েন নানা অনিয়ম দুর্নীতিতে।
এ ধারাবাহিকতায় তিনি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জন্য স্থানীয় মো. ফরিদ নামের এক ব্যবসায়ীকে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিজস্ব জমি লিজ দেন। পরে তিনি এ টাকা রাজস্ব ফান্ডে জমা না করে সম্পূর্ণ টাকা আত্মসাৎ করেন। শুধু তায় নয়, ক্যাশিয়ার আব্দুল ছত্তার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে জাতীয় কর্মসূচী, ট্রেনিংয়ের সম্মানি, উৎসব ভাতা ও চিত্তবিনোদন ভাতা উত্তোলন করতে উৎকোচ নিয়ে থাকেন। এছাড়া কর্মকর্তা কর্মচারীরা চিকিৎসা জনিত ছুটি, মার্তৃত্বকালীন ছুটি এবং এলপিসি ইস্যু করার জন্যও দিতে হয় উৎকোচ। ক্যশিয়ার আব্দুল ছত্তার বিভিন্ন প্রোগ্রাম সহ অফিসিয়াল কাজের আনুসাঙ্গিক জিনিসপত্র ক্রয় দেখিয়ে ভূয়া বিল ভাউচার করে টাকা আত্মসাৎ করে আসছেন।
২০২৪-২৫ অর্থ বছরে কর্মরত ১১জন ৪র্থ শ্রেণি কর্মচারীর সাজ পোশাক বিতরণের জন্য প্রতিজন কর্মচারীর কাছ থেকে তিনি ২ হাজার টাকা হারে নেন। পরবর্তীতে পোশাক না দিয়ে কর্মচারীদের ১৫ হাজার টাকার স্থলে নগদ ৮ হাজার টাকা হারে বিতরণ করা হয়। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী আয়া মমতাজ বেগম বলেন, ক্যাশিয়ার আমার কাছ থেকে চাকুরী স্থায়ী করণ ও সাজ পোশাকের জন্য ৪ হাজার টাকা নেন। এদিকে সাজ পোশাক ভাতা আসার পর বিল উত্তোলনের কথা বলে ক্যাশিয়ার আবদুল ছত্তার দুইধাপে প্রতিজন কর্মচারীর নিকট হতে ১হাজার ২০০টাকা নিয়েছেন বলে জানান কুক-মশালচি নুসরাত জাহান সুরমা। আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় কর্মরত রত্মা মজুমদার বলেন, ২০২৩ সালের জানুয়ারী মাসে আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেয়ে আমরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগদান করতে গেলে আমাদের যোগদানপত্র গ্রহণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে প্রতিজন থেকে ৪০-৫০ হাজার টাকা করে নেন ক্যাশিয়ার আব্দুস ছত্তার।
আউটসোর্সিং কর্মচারী আসমাউল হোসনা লুৎফা বলেন, বেতন ভাতা বরাদ্ধের জন্য ঢাকা থেকে চাহিত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ক্যাশিয়ার আবদুল ছত্তার ঢাকা যাওয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকে ১০হাজার টাকা নিয়েছেন। অথচ একই কাজের জন্য তিনি পরপর ২টি টিএ-ডিএ বিলও উত্তোলণ করেন বলে শুনেছি। বেতন ভাতা বরাদ্ধ পাওয়ার পর ৬ মাসের বেতন ভাতা উত্তোলণের জন্য ক্যাশিয়ার আব্দুল ছত্তার আবারও প্রতিজন কর্মচারীর নিকট থেকে ৭ হাজার টাকা করে নেন। বেতনের সব টাকা যদি ক্যাশিয়ার আর উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে দিয়ে দিতে হয়, তাহলে চাকুরী করে আর কি লাভ।
লামা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী মো. আবদুল ছালাম জানায়, তার অবসরোত্তর কালীন সময় ক্যাশিয়ার ছাত্তার লাম্পগ্রান্ড মঞ্জুরের জন্য ১৫ হাজার টাকা ঘুষ দাবী করেছিলেন। ঘুষ না দেয়ার কারণে দীর্ঘদিন তার ফাইল আটকে রেখেছিলেন। ওয়ার্ড বয় মানিক চন্দ্র দাশ ও অফিস সহায়ক শ্রীমন্ত কুমার দাশ জানান, আমাদের লাম্পগ্রান্ড মঞ্জুরের জন্য ছাত্তারকে ঘুষ দিতে হয়েছে। স্বাস্থ্য সহকারী মো. রমিজ উদ্দিন বলেন, আমরা ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৩ জন স্বাস্থ্য সহকারী তাদের শ্রান্তি বিনোদন ভাতা (রেস্ট এন্ড রিক্রেইশন) ভাতা উত্তোলন করতে গেলে আব্দুল ছত্তার অফিস খরচের কথা বলে দুই ধাপে প্রতিজন থেকে ১০০০ টাকা হারে আদায় করেন।
স্বাস্থ্য সহকারী মিজানুর রহমান বলেন, আমাদের চাকুরি খতিয়ান বহি হালনাগাদ করার জন্য প্রাক্তন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনাা কর্মকর্তা ডা. সৈয়দ আহমদ স্যারের স্বাক্ষর নেয়ার জন্য ঢাকা যেতে হবে বলে প্রতিজন স্বাস্থ্য সহকারীর নিকট হতে ১৫ হাজার টাকা করে নেন। আমরা ৫ জন স্বাস্থ্য সহকারী তাকে ১০ হাজার টাকা করে ৫০ হাজার টাকা প্রদান করি। কিন্তু ঢাকা না গিয়ে চাকুরি খতিয়ান বহিতে নিজেই ভুয়া স্বাক্ষর প্রদান করে হালনাগাদ করেন এ ক্যাশিয়ার। আমাদের কর্মচারীদের প্রায় চাকুরি বহিতে তিনি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ভুয়া জাল স্বাক্ষর প্রদান করেছেন। অনেকের এসিআরওতে ভুয়া স্বাক্ষর দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে কোনো ভাতা ও টিএ-ডিএ বিল উত্তোলন করতে ২০-৩০ শতাংশ হারে উৎকোচ দিতে হয় ক্যশিয়ার আব্দুল ছত্তারকে।
যারা তার চাহিদা মতো টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন কিংবা প্রতিবাদ করেন তাদের-কে বিভিন্নভাবে হয়রানি করে থাকেন তিনি। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত অফিস সহায়ক নুর মোহাম্মদ বলেন, আমি একজন সাসপেনশন কর্মচারী, আইবাস++ এ আমার বেতন আপডেট করার কথা বলে ক্যাশিয়ার আবদুল ছত্তার আমার কাছ থেকেও ২ হাজার ৫০০ টাকা নিয়েছেন। এছাড়াও ক্যাশিয়ার আবদুল ছত্তার তৃতীয় শ্রেণি কর্মচারী হলেও ২০২১ সাল থেকেই তিনি অন্যায়ভাবে ডক্টরস কোয়ার্টারে একসীট বরাদ্ধ দেখিয়ে তিনি পুরো কোয়ার্টার ব্যবহার করে আসছেন। তিনি উক্ত কোয়ার্টার বিভিন্ন ইন্টার্ণশিপ শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের সাব ভাড়া দিয়েও টাকা আদায় করে থাকেন।
স্টোর কিপার নাওফেল জানান, ক্যাশিয়ার আব্দুল ছত্তার আইবাস++ ডিডিও আইডির অপব্যবহার করে ২০২৩-২৪ এবং ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে প্রায় ১৮ মাস তার এককক্ষ বাসা বরাদ্ধের ভাড়া কর্তন করেননি। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ১৮ মাসের বাসা ভাড়া পরিশোধ করার জন্য বলার পরেও তিনি এখন পর্যন্ত টাকা জমা করেননি। ডিগ্রিখোলা কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি মাসুদ খাঁন বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধীনে যতগুলো কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে, ওই সকল কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি’দের বিভিন্ন পরিবহন বিল, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বিল উত্তোলণে এজি (হিসাব রক্ষণ) অফিসের নাম ব্যবহার করে ৩০-৪০ শতাংশ হারে টাকা কর্তন করে রাখতেন আবদুল ছত্তার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কয়েকজন নার্স ও মিডওয়াইফ জানান, মার্তৃত্বকালীন ছুটির আবেদন, শ্রান্তি বিনোদন ভাতা উত্তোলন, উচ্চতর গ্রেড মঞ্জুরের বকেয়া বিল উত্তোলণেও বড় অংকের উৎকোচ দিতে হয় ক্যাশিয়ার আব্দুস ছত্তারকে। সম্প্রতি নবযোগদানকৃত ১৯জন নার্সের পে-ফিক্সিশনের জন্য প্রতিজনের কাছ থেকে ৩ হাজার টাকা হারে উৎকোচ গ্রহণ করেন। এছাড়াও তিনি হাসপাতালের বিভিন্ন ফলজ গাছের ফলফলাদি (আমড়া, জলপাই, আম, ডাব) কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে বিক্রি করে দিয়ে সম্পূর্ণ টাকা আত্মসাৎ করেন। এছাড়াও সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক স্বপ্না সরকার এবং স্বাস্থ্য সহকারী মিজানুর রহমান এর কাছ থেকে বহিঃ বাংলাদেশ ছুটি মঞ্জুরের জন্য ১২ হাজার টাকা উৎকোচ গ্রহণ করেন ক্যাশিয়ার আবদুল ছত্তার।
হাসপাতালে কর্মরত ফার্মাসিস্ট অনিক রায়, জুনিয়র মেকানিক জহরিুল ইসলাম, কুক/মশালচি নুসরাত জাহান, বীনা বড়ুয়া, এবং নৈশ প্রহরী এছাথোয়াই জানান, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ১০ বছর পুর্তিতে উচ্চতর গ্রেড আদেশ মঞ্জুরির জন্য তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে জনপ্রতি ২ হাজার টাকা করে উৎকোচ নিয়েছেন আবদুল ছত্তার। লামা হাসপাতালের কর্মরত সাবেক মেডিকেল অফিসার জেসমিন আক্তার জানান, ক্যাশিয়ার আবদুল ছত্তার চিকিৎসকদের নানাভাবে হয়রানি করেছেন। তিনি আরো বলেন, ২০২৪ সালের এসিআর সিভিল সার্জন অফিসে প্রেরণের জন্য প্রতিজন চিকিৎসকের কাছ থেকে তিনি ৫শ টাকা করে নিয়েছেন।
জুনিয়র কনসালটেন্ট (পেডিয়াট্রিক্স) ডা. মোঃ আবদুল খালেক জানান, তাহার উচ্চতর গ্রেড মঞ্জুরের পর আইবাস++ পে-ফিক্সিশন করার জন্য ক্যাশিয়ার আবদুল ছত্তার তিনধাপে টাকা নিয়েও অদ্যাবধি কাজটি সম্পন্ন করে দেয়নি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ক্যাশিয়ার আবদুল ছত্তার বলেন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কথা বলতে পারবো না। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. গোলাম মোস্তফা নাদিম এর মোবাইল ফোনে বক্তব্য নিতে চাইলে তিনি কোন বক্তব্য না দিয়ে অফিসে দেখা করতে বলেন।