হাকিকুল ইসলাম খোকন, বাপসনিউজঃ জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ নিজের জন্মভূমির বাইরে গিয়ে অন্য কোথাও বা অন্য দেশে বসবাস করছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই শরণার্থী, অভিবাসী শ্রমিক, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী বা পেশাজীবী হিসেবে পরদেশে বসবাস করছেন। তাঁরা পরবাসী। আমাদের বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশ ভারত, চীন, রাশিয়া এবং মেক্সিকোর প্রবাসীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। মাতৃভূমিছিন্ন এই বিশাল জনগোষ্ঠী নির্দিষ্ট জাতি, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মানুষ পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করছেন। ইংরেজিতে সাধারণভাবে তাঁদের ‘ডায়াসপোরা’ বলা হয়। তাঁরা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য কোথাও চলে গেলেও নিজস্ব সংস্কৃতি, পরিচয় ও শিকড়ের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত আছেন।
ভুলতে পারেন না নিজ দেশের মায়া; কিন্তু বিদেশের মাটিতে নানা সমস্যার ভেতরে দেশের টান ভেতরেই রেখে দেন। দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোর কলামিষ্ট ওমর কায়সারের প্রবন্ধ থেকে এ লেখায় তিনি লিখেছেন, ডায়াসপোরা সম্প্রদায়ের সমস্যা বিচিত্র। অঞ্চল ও অভিজ্ঞতার ভিন্নতায় তার নানা আদল। তবে কিছু অভিন্ন সমস্যা আছে, যা প্রত্যেক অভিবাসী বা ডায়াসপোরাদের মোকাবিলা করতে হয়। প্রবাসে জন্ম নেওয়া প্রজন্মের অনেকেই শিকড়ের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলেন। তারা আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্বে ভোগেন—আমি কে? আমার দেশ কোনটা? নিজেদের দেশ ও প্রবাস—দুই জায়গার ভাষা, চালচলন, ধর্মীয় অনুশাসন, রীতিনীতি সামলানো অনেক সময় তাঁদের জন্য জটিল হয়ে পড়ে, অনেকে নাগরিকত্ব পান না। কেউ কেউ বৈধ নন, তাঁরা নানা শোষণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হন।
বিশেষ করে নিম্নআয়ের শ্রমিক শ্রেণি অনেক সময় ন্যায্য মজুরি বা নিরাপদ কাজের পরিবেশ পান না। আরেক দিকে মাতৃভূমির রাজনীতি, সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে তাঁদের অংশগ্রহণ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ বা মহামারির সময় ডায়াসপোরা জনগোষ্ঠী অনেক সময় একত্রভাবে সাড়া দিতে পারেন না। এসব ছাড়াও বহুবিধ সমস্যা রয়েছে। এর ফলে অভিবাসী জনগণ একধরনের মানসিক চাপে থাকতে থাকতে নিঃসঙ্গতায় ভোগেন। এ কারণেই সারা পৃথিবীতে দেখা যায় ডায়াসপোরা জনগোষ্ঠী নানাভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে চেষ্টা করে। যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালি বা বাংলাদেশিদের বহু সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান দেখলাম। কোথাও অ্যালামনাই হিসেবে, কোথাও জেলাভিত্তিক, কোথাও ধর্মভিত্তিক, কোথাও দেশীয় রাজনীতিভিত্তিক সংগঠনগুলো নানাভাবে সক্রিয় রয়েছে।
এসব সংগঠন তাদের প্রাণবন্ত রাখে, দেশ থেকে দূরে থাকার কষ্ট লাঘব করে, একে অপরের দুঃখকষ্টে এগিয়ে আসতে পারে। যৌথভাবে কল্যাণমূলক কাজ করতে পারে। শুধু বাংলাদেশি নয়, সারা পৃথিবীতে এ রকম হাজর হাজার ডায়াসপোরা সংগঠন রয়েছে। তবে এসব ডায়াসপোরা সংগঠনেরও নানা সমস্যা রয়েছে। এবার যুক্তরাষ্ট্রে বেড়াতে এসে পৃথিবীর ডায়াসপোরা সংগঠনগুলোকে নিয়ে একটি অভিনব প্রয়াস দেখেছি। দেখে মনে হলো বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অভিবাসীরা আজ আর শুধু নিজ নিজ জীবিকার তাগিদেই শুধু জীবন কাটাচ্ছে না। বরং তারা এখন বৈশ্বিক পরিবর্তনের অংশীদার, নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর এবং নানা জাতিগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যের মধ্যেও একতাবদ্ধ হয়ে থাকার চেতনাটি উপলব্ধি করেন। বিশাল জনগোষ্ঠীকে একটি প্ল্যাটফর্মে যুক্ত করার দূরদর্শী এই প্রচেষ্টার নাম গ্লোবাল ডায়াসপোরা কনফেডারেশন (জিডিসি)।
আইওএমএই সংগঠনকে উৎসাহিত করছে, সমর্থন দিচ্ছে এবং আর্থিক সহায়তাও দিচ্ছে। ২০২০ সালের মাঝামাঝি যখন মহামারি পৃথিবীজুড়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে, ঠিক তখনই এই সংগঠনের জন্ম হয়; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, তার আগেই শুরু হয় প্রস্তুতি। সে বছর এপ্রিলে অনুষ্ঠিত এক ভার্চু৵য়াল বৈঠকে উঠে আসে এ ধারণা—বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ২০ হাজার ডায়াসপোরা সংগঠনকে এক ছাতার নিচে আনতে হবে। উদ্দেশ্য ছিল সংযোগ, সহযোগিতা এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী একক কণ্ঠস্বর গড়ে তোলা। ওই বৈঠকের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ২৩০টি সংগঠন তাদের এক জোট হওয়ার যৌথ বিবৃতি দেয়। ১ হাজার ৪০০ স্বেচ্ছাসেবক কাজ করার ঘোষণা দেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়ায় প্রমাণিত হলো—এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি আসলে সময়ের দাবি ছিল। ২০২০ সালের জুলাইয়ে গ্লোবাল ডায়াসপোরা কনফেডারেশন (জিডিসি) আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে।
এ সংগঠনটি তিনটি মূল স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে—ডায়াসপোরা সংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করা, তাদের নেতৃত্ব ও কণ্ঠস্বর তুলে ধরা এবং তাদের টেকসই ও কার্যকর প্রভাব সৃষ্টিতে সহায়তা করা। বিভিন্ন ডায়াসপোরা সংগঠনের মধে৵ পারস্পরিক সহযোগিতার সেতুবন্ধ গড়ে তুলতে চায় তারা, আবার এমন একটি দীর্ঘমেয়াদি, টেকসই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দাঁড় করাতে চায়, যা প্রজন্মান্তরে অব্যাহত থাকে। জিডিসির বোর্ডে রয়েছে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার প্রতিনিধিত্ব। চীনা বংশোদ্ভূত বিলেতপ্রবাসী পিটার কোয়ক এ সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান চেয়ারম্যান। তাঁর সঙ্গে কাজ করছেন বেলজিয়ামের লুইজা সোয়ারেস, স্পেনের মারিয়া কার্টে, জার্মানির কাজিম ওজোয়ি এবং নেপালের একনাথ খাতিওয়াদার মতো অভিজ্ঞ নেতা। তাঁরা সবাই যাঁর যাঁর কর্মক্ষেত্রে সফল ও প্রতিষ্ঠিত। ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের সময় জিডিসি গঠন করে গ্লোবাল ডায়াসপোরা হিউম্যানিটারিয়ান হাব।
এটি ছিল সংগঠনের প্রথম বড় ধরনের কোনো কাজ। ওই সময় যুদ্ধকবলিত মানুষের জন্য মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে বিভিন্ন ডায়াসপোরা সংগঠন একযোগে কাজ করে। কনফেডারেশনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ হলো গ্লোবাল ডায়াসপোরা একাডেমি (জিডিএ) —এটি জিডিসির একটি ভার্চু৵য়াল একাডেমি। এর লক্ষ্য হচ্ছে ডায়াসপোরা নেতাদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি। এই একাডেমির আওতায় বিভিন্ন অনলাইন কোর্স, ওয়ার্কশপ এবং লিডারশিপ ট্রেনিং অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২০২৫ সালের জুনে অনুষ্ঠিত ‘ডায়াসপোরা অ্যাসেনশিয়ালস’ নামে একটি বিশেষ কর্মসূচিতে প্রায় অর্ধশত অংশগ্রহণকারী প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, অর্থায়ন, নেতৃত্ব, নেটওয়ার্কিং ও অংশীদারত্ব বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। কিন্তু ডায়াসপোরা সংগঠনগুলোর পথ সব সময় সুগম নয়। নানা চ্যালেঞ্জ তাদের সামনে—ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা, মানবাধিকার সম্পর্কে অজ্ঞতা, দক্ষতার ঘাটতি, স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সংযোগহীনতা, এমনকি জরুরি সংকটে সমন্বিত প্রতিক্রিয়া দিতে পারে না তারা।
জিডিসি এই সমস্যাগুলোকে শুধু চিহ্নিতই করেনি; বরং সমাধানের পথ খুঁজছে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) আলোকে। এত বড় ও কার্যকর একটি বৈশ্বিক নেটওয়ার্কে এখনো বাংলাদেশি ডায়াসপোরা সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। ‘আগামী ইনক’ নামে একটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন জিডিসির সদস্যপদ পেয়েছে। এ রকম একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশিদের যুক্ত হওয়া গৌরবের বিষয়। ভাবছি, তারা জিডিসির সঙ্গে যুক্ত নয় কেন? নাকি তারা জানেনই না এমন উদ্যোগের কথা? প্রশ্নের উত্তর মিলল আগামী ইনকের অন্যতম কর্ণধার সাবির মজুমদারের কাছ থেকে। তিনি বলেন, ‘হতাশ হওয়ার কিছু নেই, জিডিসির সঙ্গে বাঙালির যুক্ত হওয়া বা সম্পৃক্ততা শুরু হয়েছে। এটা আসলেই একটি ঐতিহাসিক ও বড় উদ্যোগ। বিশ্বের ডায়াসপোরাদের একটি সংগঠনের আওতায় আনার অর্থ হলো সারা বিশ্বের জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের জড়ো করা।
এটা যে একটি বড় প্রতিষ্ঠান, সেটি আমি বুঝেছি ওদের বার্ষিক সম্মেলন এবং অন্যান্য কর্মসূচির মাধ্যমে। আমাকে ওরা ওদের কার্যকর কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে।’ সাবির মজুমদার বর্তমানে জিডিসি ফান্ড রাইজিং টিমের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। গত জুন মাসে গ্লোবাল ডায়াসপোরা একাডেমি আয়োজিত ‘ডায়াসপোরা অ্যাসেনশিয়ালস: টুলস ফর সাসটেইনেবল ইমপ্যাক্ট’ শীর্ষক একটি প্রশিক্ষণ সেশনে নেতৃত্ব দেন। সাবির মজুমদার বললেন, ‘ডায়াসপোরা নিয়ে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা হয়, সম্মেলনও হয়; কিন্তু বিশ্বপরিসরে নিজেদের অবস্থান জানানোর জন্য এমন একটি সংগঠনের সঙ্গে অংশীদারত্ব গড়ে তোলার কৌশলগত চিন্তা আমাদের এখনো তৈরি হয়নি।’ জিডিসি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, প্রবাসীরা শুধু অর্থ পাঠায় না, তারা নৈতিক শক্তি, সাংস্কৃতিক দূত এবং বৈশ্বিক নেতৃত্বের সম্ভাবনাও তৈরি করে। আজ যখন বিশ্বজুড়ে বিভাজন, বিভ্রান্তি আর বৈষম্য বাড়ছে, তখন জিডিসির মতো প্ল্যাটফর্ম আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য সম্ভব। তবে সবাই মিলে একসঙ্গে চলতে হবে। ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদককে এ লেখার জন শুভেচ্ছা,নিরন্তর ভালোবাসা এবং আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই ।