রাজশাহী প্রতিনিধি:আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ভোটের মাঠে সরব। বিএনপির শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী যখন মাঠঘাট চষে ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করছে, তখন রাজশাহীর মোহনপুরে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। স্থানীয় বিএনপির কিছু নেতা নির্বাচনী প্রচারণা ছেড়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন অবৈধ পুকুর খননের ব্যবসায়।
উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মাহবুব আর রশিদ-এর নাম ভাঙিয়ে একদল নেতা প্রশাসনের প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে পুকুর খননের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্যে নেমেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
স্থানীয়দের দাবি, এই কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাহানাবাদ ইউনিয়নের বিএনপি ক্যাডার হিসেবে পরিচিত রুহুল ওরফে ডেভিল, যিনি দীর্ঘদিন ধরে উপজেলা বিএনপির প্রভাবশালী নেতা মাহবুব আর রশিদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
অভিযোগ রয়েছে, রুহুল প্রশাসনের নাম ব্যবহার করে পুকুর খননকারীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করছেন। টাকা না দিলে তাদের পুকুর খননের অনুমতি দেওয়া হয় না।
স্থানীয়দের ভাষায়, রুহুলকে টাকা না দিলে ভেকু মেশিন মাঠে ঢুকতে পারে না।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, গত এক বছরে রুহুলের নির্দেশে মোহনপুর উপজেলার বিভিন্ন বিলে প্রায় তিনশ বিঘা কৃষিজমি পুকুরে রূপান্তরিত হয়েছে। এর ফলে কৃষিজ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার জাহানাবাদ ইউনিয়নের কয়েকটি স্থানে এক্সেভেটর (ভ্যেকু) মেশিন দিয়ে দ্রুতগতিতে কৃষিজমি কেটে পুকুর খননের কাজ চলছে।
জাহানাবাদ ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বিরহী বিলে প্রায় ২০ বিঘা জমিতে পুকুর খনন করছেন।
একই ইউনিয়নের মতিহার স্কুলের পাশে প্রায় ২৪ বিঘা জমিতে সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ ভুট্টু খনন করছেন।
বাকশিমইল ইউনিয়নের ভেটুপাড়া বিলে প্রায় ১০ বিঘা জমিতে হেলাল নামের এক ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে খনন চলছে।
স্থানীয় কৃষক আব্দুল হান্নান বলেন, এই এলাকায় ভেকু চালাতে গেলে আগে রুহুলের অনুমতি লাগে। সে বলে—‘সব কিছু ম্যানেজ করা আছে’। এখন কৃষক হয়ে আমরা ভাড়াটিয়া।”
অবৈধভাবে পুকুর খননের অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে জাহানাবাদ ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা উপজেলার নেতার মাধ্যমে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই পুকুর খনন করছি। এলাকাতেও আমরা সব কিছু ম্যানেজ করেছি।”
এই বক্তব্য প্রকাশের পর বিএনপির অভ্যন্তরে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। অনেক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এমন কর্মকাণ্ড দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে এবং নির্বাচনী মাঠে নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা তৈরি করছে।
একদিকে জামায়াত মাঠে সক্রিয় প্রচারণায় ব্যস্ত, অন্যদিকে বিএনপির কিছু স্বার্থান্বেষী নেতা পুকুর খননের মতো ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ায় তৃণমূল পর্যায়ে দলে হতাশা দেখা দিয়েছে। স্থানীয় নেতাকর্মীদের আশঙ্কা—এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে জনগণের আস্থা হারাচ্ছে বিএনপি।
উপজেলা বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “কৃষিজমি নষ্ট করে কেউ প্রশাসনের নাম ভাঙাবে, এটা আমাদের রাজনীতির নীতি নয়। দলীয় ভাবমূর্তি রক্ষায় শীর্ষ নেতৃত্বের দ্রুত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।”
এলাকাবাসির অভিযোগ, প্রশাসনের কিছু অসাধু ব্যক্তি গোপনে এই অবৈধ কর্মকাণ্ডে মদদ দিচ্ছেন। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, “দিনের বেলায় প্রকাশ্যে এক্সেভেটর চলে, অথচ প্রশাসন নীরব থাকে—এটা কীভাবে সম্ভব?”
জেলা প্রশাসন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে এলাকাবাসি অবৈধ পুকুর খননের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
কৃষিজমি ধ্বংসের প্রতিবাদে স্থানীয় কৃষক সমাজ, সচেতন নাগরিক ও তরুণ প্রজন্ম প্রশাসনের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন।
তাদের মতে, নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতাদের এমন কর্মকাণ্ড শুধু দল নয়, পুরো রাজনৈতিক পরিবেশকে কলুষিত করছে।”
মোহনপুরের এই পুকুর খনন কাণ্ড শুধু কৃষিজমি ধ্বংস নয়—এটি এখন প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা ও রাজনৈতিক নৈতিকতার প্রশ্ন।
নির্বাচনের সময় যেখানে জনগণ পরিবর্তনের আশায় রাজনীতির দিকে তাকায়, সেখানে নেতাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে পুকুর ব্যবসা—জনগণের বিশ্বাস ভেঙে দিচ্ছে এবং দলের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।