কলাপাড়া( পটুয়াখালী)প্রতিনিধি। নৌ পরিবহন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম শাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘সঠিক মাস্টার প্লানের মাধ্যমে পায়রা বন্দরকে আধুনিক বন্দর হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।’ ‘আমাদের কোনো বন্দরই আন্তর্জাতিকভাবে গড়ে ওঠেনি। এমনকি চট্রগ্রাম বন্দরেরও সেভাবে আন্তর্জাতিক কানেকশন নেই। আমরা নতুন এ বন্দরের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। পরবর্তীতে নতুন সরকার এসে এ বন্দরের কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাবে। পায়রা বন্দর যাতে টাকা বরাদ্দ পায়, আমি সে চেষ্টাও করে যাচ্ছি। পায়রা বন্দরকে ঘিরে বিভিন্নমুখী পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছে। আমরা পায়রা বন্দরকে গ্রীণ পোর্ট হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।’
নৌ পরিবহন উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘আমরা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এবং বিদেশীদের বলছি তাঁরা যেন বিনিয়োগে আগ্রহী হয়। বরিশালে যদি আমরা কনটেইনার টার্মিনাল করি, তাহলে হয়তো ভালো হবে। আমাদের দেশের নদী পথ যেন আরও সচল হয়, সে জন্যও আমি চেষ্টা করছি। পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেল লাইন আসলে, এ বন্দর আরও কার্যকর হবে।’
পায়রা বন্দরের উন্নয়ন কর্মকান্ডের মাস্টারপ্লান নিয়ে অনুষ্ঠিত এক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। রোববার(২০ জুলাই) বেলা সাড়ে ১১টায় পটুয়াখালীর কুয়াকাটা পর্যটনকেন্দ্রের একটি অভিজাত হোটেলে এ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘এখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। এমন সময় বৃষ্টি হচ্ছে, যখন আমাদের বৃষ্টির প্রয়োজন নাই। আবার এত বেশি গরম পড়ছে, খরা হচ্ছে যাও সহনশীল নয়। এসব জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব।’
পায়রা বন্দরে পার্শ্ববর্তী দেশের মাধ্যমে আরও দুটি টার্মিনাল করার কথা থাকলেও আপাতত তা হচ্ছেনা। হয়তো পরবর্তীতে হতে পারে বলে নৌ পরিবহন উপদেষ্টা আশাবাদ ব্যক্ত করেন।পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের (পিপিএ) চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মাসুদ ইকবাল এ কর্মশালায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন। স্বাগত বক্তব্যে তিনি ২০২৬ সালের জুলাই মাস হতে পায়রা বন্দরের প্রথম টার্মিনালের অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এ জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট সবার প্রস্তুতি ও সহযোগিতা কামনা করেন। এ ছাড়া ড্রেজিংসহ অত্যাবশ্যক কয়েকটি কাজ সম্পাদনে তিনি সরকারের সহায়তা চেয়েছেন। বুয়েটের একটি বিশেষজ্ঞ দল এবং নেদারল্যান্ডের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রয়েল হাসকনিং দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে কাজ করে পায়রা বন্দরের জন্য মাস্টারপ্লান তৈরি করেছে। তাঁদের গবেষণালব্দ এ মাস্টারপ্লান বাস্তবায়ন করা হলে ভবিষ্যতে বন্দরটি দেশের এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে বলে তিনি মনে করেন।
এ সময় বন্দর চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘আগামী তিন বছরের মধ্যে পায়রা বন্দর রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে নিজস্ব সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে। পায়রা বন্দরকে সচল রাখতে হলে ড্রেজিং করতে হবে। ড্রেজার ক্রয় করার জন্য একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে ড্রেজিংয়ের খরচ কীভাবে কমানো যায়, সে চিন্তা আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে যাতে স্থানীয় পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর কোনো প্রভাব না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রেখে বন্দরের যাবতীয় কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে।’
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে আরও বলেন, ‘ভাঙা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত চারলেনের সড়ক দ্রুত বাস্তবায়ন করার দাবি করছি। বহুল আকাংখিত এ সড়কটির নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করা হলে পায়রা বন্দরে নোঙর করা জাহাজ থেকে খালাস করা মালামাল দ্রুত সড়ক পথে পরিবহন করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছানো সম্ভব হবে।’
পায়রা বন্দরের মাস্টারপ্লান প্রকল্পের ওপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নেদারল্যান্ড ভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রয়েল হাসকনিং ডিএইচভির দলনেতা এবং আন্তর্জাতিক বন্দর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ মি. মেনো মুইজ। এ সময় তিনি বলেন, ‘পায়রা বন্দরকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা করা হয়েছে। বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের মংলা বন্দরের চেয়ে পায়রা বন্দরের সম্ভাবনা বেশি রয়েছে। ভবিষ্যতে এ বন্দর ব্যবহার করে বিনিয়োগকারী এবং অংশীজনরা সুফল ভোগ করতে পারবে বলে জানান তিনি।’
পায়রা বন্দরের মাস্টারপ্লান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন মাস্টারপ্লান প্রকল্পের দলনেতা এবং বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ইসতিয়াক আহমেদ। এ সময় তিনি বলেন, ‘২০১৭ সাল থেকে শুরু করে দীর্ঘ সময় কাজ করার পর আমরা ২০২৩ সালে মাস্টারপ্লান চুড়ান্ত করতে সক্ষম হই। মাস্টারপ্লান পরিবর্তনযোগ্য, প্রয়োজনে এটা পরিবর্তন করা যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নতুন করে যেহেতু এখানে বন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে, সে কারণে এ বন্দরকে গভীর সমুদ্র বন্দর করা সম্ভব। আমরা সেভাবেই পরামর্শ দিয়েছি। বন্দর যখন পুরোপুরি সচল হবে, তখন ঠিকই এ বন্দর লাভজনক পর্যায়ে যাবে। এ নিয়ে হতাশ হওয়ার কিছু নাই।’
পায়রা বন্দরের উন্নয়ন, অগ্রগতি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে ভিডিও ডকুমেন্টারি উপস্থাপন করেন পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের (পিপিএ) সদস্য (প্রকৌশল ও উন্নয়ন) কমোডর মোহাম্মদ আবদুল কাদের। এ সময় তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেশের চট্রগ্রাম এবং মংলা বন্দর দিয়ে আমদানী-রপ্তানী কার্যক্রম সচল রাখা সম্ভব হচ্ছেনা। যার কারণে নতুন একটি বিকল্প বন্দর গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর সে বন্দরটিই হচ্ছে বহুল আকাংখিত পায়রা বন্দর। পায়রা বন্দরের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে বন্দরের পাশ দিয়ে ৭৫ কি. মি. দীর্ঘ প্রাকৃতিক রাবনাবাদ চ্যানেল রয়েছে। এ চ্যানেলটির গভীরতা সাড়ে ১০ কি. মি.। যা বন্দরের জন্য অত্যন্ত সুবিধাজনক। এ চ্যানেল ব্যবহার করে অনায়াসে পণ্য নিয়ে বিদেশ থেকে আসা জাহাজ বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারবে।’ ২০৪১ সালের মধ্যে পায়রা বন্দর দেশের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখবে বলে তিনি মনে করেন।
এ ছাড়া সেমিনারে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, সামরিক ও বেসামরিক সংস্থার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বরিশাল বিভাগ ও পটুয়াখালী জেলা প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ, দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ, বন্দর ব্যবহারকারী-অংশীজনসহ গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের মোট আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯৩ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে। ২০১৬ সালের ১৩ আগষ্ট এ সমুদ্র বন্দরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। অপরদিকে ২০২২ সালের ২৭ অক্টোবর উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের চাড়িপাড়ায় পায়রা বন্দরের প্রথম টার্মিনালের (পিপিএফটি) উন্নয়নমূলক কার্যক্রম শুরু হয়।
সেমিনারের দ্বিতীয় অধিবেশনে বিভিন্ন অংশীজনের পক্ষ হতে মাস্টারপ্ল্যান ও সামগ্রিকভাবে পায়রা বন্দরের অগ্রগতি বিষয়ক মন্তব্য ও পরামর্শ প্রদান করা হয়।